বাসস
  ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৫৩
আপডেট  : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:২৪

সুনামগঞ্জের প্রথম শহিদ হৃদয় : ঠাঁই পেয়েছেন মানুষের হৃদয়ে

॥ আল-হেলাল মোঃ ইকবাল মাহমুদ ॥
সুনামগঞ্জ, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র -জনতার আন্দোলনে সুনামগঞ্জের প্রথম শহিদ মোহাম্মদ হৃদয় শৈশব থেকেই ছিলেন পিতামাতার স্নেহবঞ্চিত। কিন্তু  এই আন্দোলনে শহিদ হয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন সুনামগঞ্জবাসীর হৃদয়ে।

তবে তার ঠাঁই হলো না নিজ জন্মভিটায়। মৃত্যুর পরে শেষ ঠিকানা হলো নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সিদ্ধিরগঞ্জ পুল মিজমিজি বাতানপাড়ার পাইনাদি কবরস্থানে। যেন নিয়তিই তাকে বাবা-মা’র কোল থেকে চির বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

হৃদয়ের পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, ২০ জুলাই শনিবার সন্ধ্যা ৬ টায় সিদ্ধিরগঞ্জে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের  পক্ষে এলাকার শ্রমিক জনতাসহ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী সমর্থকরা অংশ নেন। মিছিলে যোগ দেন মোহাম্মদ হৃদয়(২৭)।   ঐ সময় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমানের নির্দেশে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের  নেতাকর্মীরা ছাত্র জনতার ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। সন্ধ্যা  সোয়া ৬টার দিকে মোহাম্মদ হৃদয় প্রতিদিনের মতো কাজে বেরিয়ে ভূমি পল্লী আবাসিক এলাকার পাকা রাস্তায় পৌঁছালে তাকে গুলি করা হয়। কপালে গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যু হয় তার। পথচারীরা তাকে সেখান থেকে নিয়ে চিটাগাং রোডের সুগন্ধা হাসপাতালের সামনে রাস্তার ওপর রেখে চলে যায়। পরে খবর পেয়ে তার খালা শাহিদা বেগম ও মামা হারেস মিয়া তাকে বাসায় নিয়ে যান।


হৃদয়ের মামা হারেস মিয়া বলেন, গত ২০ জুলাই শনিবার সন্ধ্যায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে কপালের ডানদিকে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে মারা যায় আমার ভাগ্নে। আমি সাড়ে ৬টায় ঘটনার কথা জানতে পেরে ৭টার সময় হাসপাতালে পৌঁছি। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই তার নাকমুখে রক্ষক্ষরণ হয়েছে। চিকিৎসার আগেই মারা গেছে হৃদয়। এ অবস্থায় একটা ভ্যানগাড়িতে তুলে ভাগ্নের লাশ নিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হই। বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি কমপক্ষে ১৫ জনের লাশ গাড়িতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ঐ রাতেই গ্রামের বাড়িতে হৃদয়ের লাশ নিয়ে যেতে চাইলেও কোন পরিবহন পাইনি। পরে ভয় ও আতংকের মধ্যে সারারাত অপেক্ষা করে পরদিন রোববার সকাল ৭টায় জামায়াত নেতা মোশাররফ হোসেনের সহায়তায় লাশ দাফন করি।

তিনি বলেন, ছাত্রদের সাথে বন্ধুত্বের কারণেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় হয় হৃদয়। বাংলাদেশ জামাতে ইসলামী সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার নেতৃবৃন্দ শহিদ হৃদয়ের পরিবারের হাতে নগদ ২ লক্ষ টাকা অনুদান প্রদান করায় তিনি সংগঠনটির সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

হৃদয়ের খালা শাহিদা বেগম জানান, সিদ্ধিরগঞ্জের নাসিক ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরউদ্দিন মিয়া হৃদয়ের লাশ দ্রুত দাফনের জন্য চাপ প্রয়োগ করায় তারা সুনামগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে লাশ নিয়ে যেতে পারেননি। সকল চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় মো. হৃদয়ের মৃতদেহ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১নং ওয়ার্ডের সিদ্ধিরগঞ্জ পুলের মিজমিজি বাতানপাড়ার পাইনাদি কবরস্থানেই দাফন করা হয়।

ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত মোহাম্মদ হৃদয় সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের দূর্গাপুর গ্রামের মো. ছফেদ আলি ও মনোয়ারা খাতুন দম্পতির প্রথম সন্তান। যদিও হৃদয়ের দুই বছর বয়সেই তার মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে যায়। বাবা বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। মায়ের সাথে নানা বাড়িতে ঠাঁই হয় তার।  নানা আব্দুল মোতালিব পেশায় দিনমজুর  ও নানী হনুফা খাতুন গৃহবধু।  জীবিকার তাড়নায়  তার নানা-নানী  পরিবারসহ সুনামগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জে চলে যান। ২০ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জেই বাস করছেন তারা।

হৃদয়ের পাঁচ বছর বয়সে তার মা মনোয়ারা  পুনরায় বিয়ে করে নেত্রকোনা চলে যান। তারপর থেকে নানা-নানির কাছেই বড় হন হৃদয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হৃদয়ের ঠিকানা ছিলো নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ৪নং ওয়ার্ডের সিদ্ধিরগঞ্জের আটি হাউজিং ১নং গলির জহুর মিয়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া হিসেবে।

নানার সহায়তায় হৃদয় সিদ্ধিরগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। পরে নানার টানাপোড়েনের সংসারে সহায়তা করতে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে প্রথমে দিনমজুরি করতেন। পরে কাজ শিখে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় থাই গ্লাস মিস্ত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন।  

হৃদয়ের মামা মোশাররফ হোসেন জানান, হৃদয়ের বাবা-মা দুইজন দুই জেলার বাসিন্দা হওয়ায় কেউই হৃদয়কে শেষ দেখাটাও দেখতে পারেন নি।
অশীতিপর বৃদ্ধ নানা আব্দুল মোতালিব (৮৬) আর নানি হনুফা খাতুন (৭৮) চির স্নেহ-বঞ্চিত নাতি হৃদয়ের মৃত্যুতে শোকে পাথর হয়ে গেছেন। নানি হনুফা খাতুন বাসসকে বলেন,‘বড় হতভাগা কপালপুড়া ছিল আমাদের নাতি। জন্মের পর মা-বাবার আদর সোহাগ পায়নি। মরণের পরেও মা-বাবা তাকে শেষবারের মত দেখতে পারেনি। তবে আমরা পরম আদর-স্নেহে যেভাবে তাকে বড় করেছি তেমনি তার অসহায় সন্তান দুটিকেও ঠিক সেভাবেই লালন করবো।’

শহিদ হৃদয়ের স্ত্রী শিরিনা আক্তার (২২) ভোলা জেলার চরফ্যাশন থানার হাজারীগঞ্জ গ্রামের মো.আলমগীর হোসেন ও শাহনাজ বেগমের কন্যা। দিনমজুর আলমগীর হোসেনও জীবিকার তাগিদেই সিদ্ধিরগঞ্জে আবাস গাড়েন। কাজের সুবাদেই হৃদয়-শিরিনার পরিচয়- প্রেম ও বিয়ে। তাদের এক ছেলে আব্দুল্লাহ (৩) এক মেয়ে  নুসরাত আক্তার ফারিয়া (১)। শিশু সন্তানদের নিয়ে চরম বিপদে পড়েছেন শিরিনা আক্তার।

শিরিনা বলেন, ‘মাত্র ৪ বছরের দাম্পত্য জীবন ছিল আমাদের। আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি বিভিন্ন বাসা বাড়িতে থাইগ্লাস ও ডেকোরেশনের কাজ করতেন। আমাদের সুখের সংসারে ছেলে মেয়েদের নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন ছিল। কিন্তু পুলিশের গুলিতে সব স্বপ্ন ও কল্পনা অপূর্ণই থেকে গেলো। এখন আমার সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে আমি কী করবো, তাই ভেবে পাচ্ছি না।’

থানা পুলিশ সূত্র জানায়,নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের থাই গ্লাস মিস্ত্রি মোহাম্মদ হৃদয় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহতের ঘটনায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াসিনসহ মোট ১০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।  ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক মোজাম্মেল হক মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এর আগে, বুধবার (২১ আগস্ট) রাতে হৃদয়ের মা মোছাম্মৎ মনোয়ারা বেগম রিতা এই হত্যা মামলাটি দায়ের করেন।

হৃদয়ের মা মোছাম্মৎ মনোয়ারা বেগম রিতা মুঠোফোনে বাসসকে বলেন, হৃদয়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমার মন ছটফট করে ছেলেকে দেখার জন্য। কিন্তু ইচ্ছা থাকার পরও দেশের অস্থিতিশীল অবস্থার জন্য যেতে পারিনি। শহিদ হওয়ার ১৪ দিন পর সিদ্ধিরগঞ্জ পৌঁছে ২৫ দিন নাতি নাতনির সাথে সময় কাটাই। পরে সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতাদের আসামী করে থানায় মামলা করি। আমি আমার ছেলের প্রকৃত খুনি যেই হউক তার সঠিক বিচার চাই।

হৃদয় মারা যাওয়ার দুদিন আগেও মায়ের সাথে মোবাইলে কথা বলেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন,আমার ছেলে এত আগে এভাবে চলে যাবে আমি কোনদিন কল্পনাও করিনি। ২ বছরের কোলের শিশু হৃদয়কে নিয়ে অসহায় অবস্থায় জীবিকার তাগিদে মা-বাবার সাথে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গিয়েছিলাম। মৃত্যুর সময় ছেলের কাছে থাকতে না পেরে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে।

হৃদয়ের বন্ধু মুদি দোকানদার সাইফুল ইসলাম বলেন,আটি হাউজিং এর ৬নং গলিতে আমার বাসা। হৃদয় স্বপরিবারে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো ১নং গলিতে, ২নং গলিতে আছেন তার মামা হারেস মিয়া,আর নানা নানি আছেন ৫ নং গলিতে। সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। লেখাপড়া ছেড়ে থাইগ্লাসের মিস্ত্রির কাজ করলেও ছাত্রদের সাথেই তার ওঠাবসা ছিল। সে আমার দোকান থেকে কখনও বাকিতে কোন কিছু নিত না। ঋণমুক্ত সুন্দর স্বাভাবিক স্বর্গীয় জীবন ছিল তার।  

ধর্মপাশা উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়ন পরিষদের ১নং ওয়ার্ড এর মেম্বার আবুল কালাম বলেন, ছাত্র আন্দোলনে শহিদ মোহাম্মদ হৃদয় আমাদের এলাকার গর্ব ও অহংকারের নাম।
জানা যায়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত ধর্মপাশা উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের হৃদয় মিয়ার পরিবারের সার্বিক খোঁজখবর নিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে সমবেদনা জানিয়ে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও তাহিরপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন ধর্মপাশা উপজেলা বিএনপি, জয়শ্রী ইউনিয়ন বিএনপি ও সকল অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নুরুল ইসলাম নুরুল,সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি অধ্যক্ষ শেরগুল আহমদ,জেলা জামাতের আমীর মাওলানা তোফায়েল আহমদ খান,সাধারণ সম্পাদক মমতাজুল হাসান আবেদ,জমিয়তুল ওলামায়ে ইসলামের সভাপতি হযরত মাওলানা তাফাজ্জুল হক আজিজ,সাধারণ সম্পাদক মাওলানা তৈয়্যিবুর রহমান চৌধুরী, খেলাফত মজলিশের সভাপতি মাওলানা শাখাওয়াত হোসেন মোহন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডির সভাপতি দেওয়ান ইছকন্দর রাজা চৌধুরী সুবক্ত রাজাসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হৃদয়ের মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন।

তারা বলেন, বাইরে অথবা এলাকাতে যেখানেই শহিদ হন না কেন, সুনামগঞ্জের প্রথম শহিদ হলেন মোহাম্মদ হৃদয়। এই শহিদ হৃদয় আমাদের সুনামগঞ্জ জেলার গর্ব ও অহংকার। যতদিন এ জেলায় সুরমা, কালনী, কুশিয়ারা নদী প্রবাহিত থাকবে ততদিন গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় এই মহান শহিদ সূর্য সন্তানকে আমরা স্মরণ করবো।

ধর্মপাশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন ও অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো.এনামুল হক বাসস কে বলেন, ছাত্র আন্দোলনে সুনামগঞ্জের প্রথম শহিদ মোহাম্মদ হৃদয় মিয়ার পরিবারকে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সকল ধরনের সহায়তার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তারা বলেন,  যেহেতু তার স্ত্রী ও সন্তানরা এলাকার বাইরে অবস্থান করছেন তাই তাদের এলাকায় এনে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে অনুদান প্রদান করবো।