বাসস
  ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৪:৩১

বিজয় মিছিলে গিয়ে ছেলের লাশ নিয়ে ফিরতে হলো হতভাগ্য পিতাকে

॥ ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন ॥
নাটোর, ৩ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস) :  বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয় মিছিলে গিয়েছিলেন পিতা ও পুত্র। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারালেন পুত্র। বেঁচে রইলেন পিতা। বিজয়ের আনন্দ মুহুর্তেই রূপ নিলো বিষাদে। হতদরিদ্র বর্গাচাষী পিতা রাজু আহমেদকে গ্রামে ফিরতে হলো একমাত্র পুত্রের লাশ নিয়ে। 
গত ৫ আগস্ট ছিল স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার দিন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিজয়ের দিন। সারাদেশের মতো ঢাকার সাভারেও  চলে দিনভর আনন্দ মিছিল। বিজয়ের আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে যান  রাজু আহমেদ ও তার ছেলে হৃদয় আহমেদ। মিছিল থেকে বাবা ফিরলেও ছেলের আর বাড়ি ফেরা হয়নি। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে পীচঢালা রাজপথ রাঙিয়ে শহিদের নামের তালিকায় স্থান করে নেন নাটোরের হৃদয় আহমেদ (২২)।
নাটোরের চলনবিলের প্রত্যন্ত এলাকা ছাতারদিঘী গ্রামের রাজু আহমেদ আর ছপুরা বেগম দম্পতির একমাত্র পুত্র হৃদয় আহমেদ। চার ভাই বোনের মধ্যে হৃদয় তৃতীয়। অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। বর্গাচাষী রাজু আহমেদ এর একার আয়ে সংসার চলতো না। তাই ছফুরা বেগম ও ছেলে হৃদয় আহমেদ জীবিকার তাগিদে সাত বছর আগে পাড়ি জমান ঢাকার সাভারে। মা কাজ করেন পাকিজা গার্মেন্টস-এ। নাটোরের কালিগঞ্জ বনমালি ইন্সটিটিউশন থেকে অষ্টম শ্রেণী পাশ করা হৃদয় সাভারের মারহাবা গার্মেন্টস-এ অপারেটর পদে কাজ নেন। সাভার থানা রোডের পাকিজা গার্মেন্টস সংলগ্ন বড় হুজুরের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন মা-ছেলে। 
দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মা ছফুরা বেগম আর ছেলে হৃদয় আহমেদ এর যৌথ উপার্জনে সবে সংসারটা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এর মধ্যেই শুরু হয় আন্দোলন। সাভার এলাকার মিছিল-সমাবেশে সম্মুখ সারির যোদ্ধা হয়ে ওঠেন হৃদয় আহমেদ। আগস্টের এক তারিখে যোগদান করার কথা ছিলো সাভারের পাকিজা গার্মেন্টসে। এই কর্মস্থলে আগে থেকেই তার মা কর্মরত ছিলেন। কিন্তু আন্দোলন জোরালো হওয়ায় গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যায়। রাগী জেদী হৃদয় আহমেদ আরো সক্রিয় হন আন্দোলনে। 
ছাতারদিঘী  ইউনিয়ন যুবদলের প্রচার সম্পাদক রাজু আহমেদ থাকেন গ্রামে। কিন্তু  দেশের জন্য আন্দোলন করার সুযোগ পেয়ে ঢাকা চলে আসেন। ৫ আগস্টের হাজারো জনতার আনন্দ মিছিল যেন পিতা-পুত্রেরও যৌথ আনন্দের ফল্গুধারা। 
হৃদয়ের বাবা রাজু আহমেদ বাসসকে জানান, গত ৫ আগস্ট নবীনগর থেকে বিশাল আনন্দ মিছিল নিয়ে ছাত্র-জনতা সাভার থানা রোডের মুক্তির মোড় গোল চত্বরে সমবেত হয়। পুলিশ তখনো বেপরোয়া। নির্বিচারে গুলি চালায় মিছিলে। মিছিলের সামনে থাকা হৃদয়ের পেট ভেদ করে বেরিয়ে যায় একটি গুলি। বুক আর ঘাড়ে লাগে আরো তিনটি গুলি।  লুটিয়ে পড়েন রাজপথে। চারিদিকে রক্তের বন্যা। সহযোদ্ধারা নিয়ে যান এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিন দিন মেডিকেলের আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ৮ আগস্ট হৃদয় ইন্তেকাল করেন। 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ৮ আগস্ট হৃদয়ের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান মরদেহ। হাজারো মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে জানাজার পরে দাফন করা হয় হৃদয়কে। হৃদয়কে আর পরিবারের আয় বৃদ্ধির জন্যে চাকুরিতে যাওয়ার কথা ভাবতে হবে না। দেশের মুক্তির কথা ভাবতে হবে না। দুরন্ত হৃদয় নিজের হৃদয়কে উপহার দিয়ে গেছেন  দেশের জন্যে। বাংলাদেশের হৃদয়ে আজীবন লেখা থাকবে শহিদ হৃদয়ের নাম।
কালিগঞ্জ বনমালি ইন্সটিটিউশনের সহকারী শিক্ষক তোফাজ্জল হোসেন বাসসকে বলেন, সহজ-সরল প্রকৃতির প্রাণখোলা ভালো মনের মানুষ ছিলো হৃদয়। শিক্ষকসহ সবাইকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতো। দেশের জন্যে জীবন উৎসর্গ করে হৃদয় গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। 
ছাতারদিঘী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুর রউফ সরদার জানান, এলাকার টগবগে যুবক হৃদয়ের সাথে সকলের সুসম্পর্ক ছিলো। তার কথা দেশবাসি মনে রাখবেন। 
নাটোর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহ কমিটির সদস্য অধ্যাপক কাজী গোলাম মোর্শেদ বলেন, শহিদ হৃদয় আমাদের হৃদয়ে থাকবেন আজীবন। ভবিষ্যতে এলাকায় হৃদয়ের নামে কোনো স্থাপনার নামকরণ করারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। 
এদিকে শোকে পাথর হয়ে গেছেন হৃদয়ের মা ছপুরা বেগম। কান্না ছাড়া তার কোনো ভাষা নেই এখন। ছেলের কথা উঠলেই ডুকরে কেঁদে উঠছেন তিনি। 
হৃদয়ের বাবা রাজু আহমেদ নিজেকে সামলে নিয়েছেন অনেকটাই। সাভার থানায় পতিত সরকার প্রধান শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। শুরু হয়েছে মামলার তদন্ত। ছেলে হত্যার বিচার দাবী করে রাজু আহমেদ বলেন, ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে এদেশে রোধ হবে দুঃশাসন। আর কোন স্বৈরাচার সৃষ্টি হবে না।’
পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, হৃদয় আহমেদ এর পরিবারকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেযারপারসন তারেক জিয়ার পক্ষ থেকে এক লাখ  ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন থেকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন বলেও পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।