বাসস
  ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:৩১

স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, কিন্তু ফেরা হলো না সাইফুল হাসানের

॥ মুহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ ॥
গাজীপুর, ৩ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস): ‘স্বৈরাচারের পতন হলেই ঘরে ফিরবো’- এ কথা বলে গত ২ আগস্ট স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন সাইফুল হাসান। গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচারি সরকারের পতন হলেও স্ত্রী-সন্তানের কাছে আর ফেরা হলো না নারায়ণগঞ্জের সাইফুল হাসানের।  
শহিদ সাইফুল হাসান (৫২) নারায়ণগঞ্জের ডেমরা নিবাসী মরহুম জোবেদ আলী ও হায়াতুন্নেছার পুত্র। সাত ভাই বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। সাইফুল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাঁধন হিজড়া সংস্থায় ( বিএইচএস) এ প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চাকরি সূত্রে তিনি গাজীপুর জেলার টঙ্গির গাজীপুর ডিআইটি আবাসিক এলাকায় বাস করতেন।
সাইফুল হাসানের স্ত্রী রুনা পারভীন বাসসকে জানান,  গত ২ আগস্ট সকালে তিনি বাসা থেকে বের হন। যাওয়ার সময়ে বলেছিলেন, ‘স্বৈরাচারের পতন হলেই ঘরে ফিরবো’। পরে স্ত্রীকে ফোনে বলেন, ‘কুড়িলে এক ব›ধুর বাসায় আছি। সরকার পতন হলে ঘরে ফিরবো। আমার জন্য কোনো দু:শ্চিন্তা করো না।’ এরপর আর কথা হয়নি তাদের।  
রুনা জানান, গত ৫ আগস্ট দুপুর ১২ টার দিকে আন্দোলনের সহযোদ্ধা কোন এক ছাত্র রুনা পারভিনকে টেলিফোনে তার স্বামীর আহত হওয়ার খবর দেন এবং তাকে দ্রুত  কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যেতে বলেন। খবর পেয়ে রুনা কুর্মিটোলা হাসপাতালে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে হাসপাতালের মর্গে স্বামীর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন। ঐ মুহূর্তে রুনা পারভীনের আর্তনাদ শোনার মতও কেউ ছিলোনা। নিজেকে সামলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিয়ম মেনে তিনি লাশ গ্রহণ করে টঙ্গিতে নিয়ে আসেন। টঙ্গিতে জানাযার নামাজ শেষে নারায়ণগঞ্জের ডেমরার কোনাবাড়িতে নিয়ে সাইফুলের বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাইফুল হাসান ৫ আগস্ট সকাল ১১ টার দিকে ছাত্রদের সাথে মিছিল নিয়ে বসুন্ধরা এলাকার যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে আসলে বিপরীত দিক থেকে পুলিশ মিছিলের ওপর সরাসরি গুলি চালায়। এসময় পুলিশের একটি গুলি সাইফুলের মাথার  বাম পাশ দিয়ে ঢুকে ডান পাশ দিয়ে মগজসহ বের হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সাইফুল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে থাকেন। এসময় আন্দোলনকারী ছাত্রদের কয়েকজন দ্রুত তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সাইফুল-রুনা দম্পতির দুই ছেলে। বড় ছেলে মো. রিওশান রাফী (১৯) টঙ্গি সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ছোট ছেলে মো. রিদওয়ান আল রাইয়্যান (১৪) কোরআনের হাফেজ। সে বর্তমানে টঙ্গি তামীরুল মিল্লাত মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। দুই ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিলো সাইফুল হাসানের। ইচ্ছে ছিলো ছোট ছেলেকে মদীনা ইউনিভার্সিটিতে পড়াবেন। কিন্তু তাদের স্বপ্নের সে বাতিঘর আজ অনেক দূরের বিষয়।
রুনা পারভিন বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বাসসকে বলেন, আমার জীবনে এমন দুঃস্বপ্ন নেমে আসবে তা কখনো ভাবতে পারিনি। আমি জানি না সামনের দিনগুলো আমাদের কিভাবে কাটবে। দুই ছেলে এখনো ছোট। তাদেরকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো তাদের বাবার। জানি না আমি কী করতে পারবো তাদের জন্য।
সাইফুল হাসানের শতবর্ষী মা হায়াতুন্নেছা বার্ধক্যজনিত নানাবিধ রোগে ভুগছেন। বড় ছেলের সাথে নারায়ণগঞ্জের ডেমরায় স্বামীর ভিটায়ই থাকেন। তিনি স্পষ্ট করে কথা বলতে পারেন না। আন্দোলনে শহিদ  সাইফুলের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি ডুকরে কেঁদে ওঠেন। কান্নাজড়িত কন্ঠে কিছু বলতে চেষ্টা করেন। আর বুক ভাঙ্গা কান্নায় মুষড়ে পড়েন। রুনা জানান, অসুস্থ মায়ের প্রতি সাইফুল খুব খেয়াল রাখতেন। নিয়মিত মায়ের খোঁজ খবর নিতেন।
সাইফুলের সহকর্মী একই প্রতিষ্ঠানের ফাইন্যান্স এন্ড এডমিন অফিসার হিসেবে কর্মরত সাব্বির হোসেন কাদেরি বাসসকে বলেন, সাইফুল হাসান একজন সৎ, সাহসী ও ন্যায়পরায়ন মানুষ ছিলেন। অমায়িক ব্যবহারের জন্য সহকর্মীদের সাথেও খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। সাইফুল সাহেবের এই মৃত্যুতে সহকর্মীরা গভীরভাবে মর্মাহত।
সাইফুলের পরিবার জানায়, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে সাইফুলের পরিবারকে এক লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে।