শিরোনাম
॥ মো: আব্দুর রাজ্জাক ॥
কুষ্টিয়া, ০৯ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস): মাত্র ৯ বছর বয়সে মা হারিয়ে মাতৃহীন আব্দুল্লাহ বাবা আর বোনদের স্নেহে ভালোই ছিলো। পরিবারের অন্য সদস্যরাও তাকে একটু বেশিই আদর করতো। কিন্ত গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে সকল বাঁধন ছিন্ন করে চলে গেলো শিশু আব্দুল্লাহ আল মুস্তাকিন (১৩)। বড় তাড়াতাড়ি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে যেন হারিয়ে যাওয়া মায়ের কাছেই চলে গেল শিশু প্রাণ।
আব্দুল্লাহ আল মুস্তাকিন কুষ্টিয়ার চর থানাপাড়া এলাকার চা দোকানী লোকমান হোসেন (৫৫) ও মৃত হ্যাপি খাতুনের একমাত্র পুত্র। চার ভাইবোনের মধ্যে সে সবার ছোট। চার বছর আগে মা মারা যাওয়ার পর থেকে বোনরাই তার দেখাশোনা করতো।
আব্দুল্লাহ'র বাবা লোকমান হোসেন (৫৫) বাসসকে বলেন, আমি ৪ আগস্ট অসুস্থ হয়ে বড় বাজার এলাকার তোফাজ্জল ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছিলাম। আমার ছেলে আব্দুল্লাহ ৫ আগস্ট দুপুরের দিকে আমাকে বলে আব্বু বাড়িতে যাচ্ছি। বাড়ির কাছাকাছি গেলে সে জানতে পারে তার দুই চাচা আন্দোলনে গেছে। এই কথা শুনে চাচাকে খুঁজতে আব্দুল্লাহ শহরের থানার মোড়ে গেলে পুলিশের এসআই সাহেব আলী খুুব কাছ থেকে আমার ছেলেকে গুলি করে। আমার ছেলে শহিদ হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের অনেক নেতারাও ছিলো পুলিশের সাথে। সন্তান হারানোর বেদনায় বিমূঢ় পিতা লোকমান হোসেন বলেন, আমি আমার একমাত্র পুত্রকে হারিয়েছি, তবুও আামি এখন গর্ব বোধ করি আমার ছেলের জীবন বৃথা যায়নি। ওর জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে।
জানা যায়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ৫ আগস্ট সকালে কুষ্টিয়া শহরে মিছিল বের হয়। মিছিলে পুলিশের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় অসহনীয় পরিবেশ তৈরি হয়। পুলিশের সাথে স্বৈরাচারি সরকারের রাজনৈতিক কর্মীরা যোগ দিয়ে তারাও গুলি চালায় আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্র-জনতার ওপর। বাবাকে হাসপাতালে রেখে দুপুরে আব্দুল্লাহ বাড়ি ফিরছিলো। পথিমধ্যে সে জানতে পারে তার দুই চাচা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে গেছে। এ কথা শুনে চাচাকে খুঁজতে যায় কুষ্টিয়া শহরের কুষ্টিয়া মডেল থানা এলাকায়। কিন্তু আব্দুল্লাহ কিছু বুঝে উঠার আগেই এক উপ সহকারি পুলিশ কর্মকর্তা খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে। ঘটনাস্থলেই শহিদ হয় আব্দুল্লাহ।
লোকমান হোসেন বলেন, আমার ছেলেকে যে পুলিশ ও যারা প্রকাশ্যে মারলো তাদের অনেকের নামে এখনও মামলা হয়নি। এখন আমার চাওয়া আমার ছেলে হত্যার সাথে প্রকৃতঅর্থেই যারা জড়িত মামলায় তাদের নাম যুক্ত করা হোক, তাদের শাস্তি হোক।
নিহতের বড় বোন মীরা (১৯) বলেন, আব্দুল্লাহ আমাদের তিন বোনের একমাত্র ভাই। সবার ছোট ছিলো এবং আমাদের খুব আদরের ছিলো। ওকে হারিয়ে আমরা এখন শূন্যতার সাগরে ভাসছি। যেদিকে তাকাই ওর স্মৃতি মনে পড়ে। আমার ভাই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, এটাই আমাদের একমাত্র সান্ত¦না। এখন আমাদের একমাত্র চাওয়া আমরা যেন আমাদের ভাইয়ের হত্যার বিচার পাই।
আব্দুল্লাহ'র চাচা শফি মন্ডল বলেন, আমরা প্রথম থেকেই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলাম। গত ৫ আগস্টও আমরা ১ দফা দাবিতে আন্দোলনে গিয়েছিলাম। আমাদের খুঁজতে সেদিন আমার ভাতিজা গিয়েছিলো থানার মোড়ে। সেখানেই এক এস আই ও আওয়ামী লীগের নেতাদের গোলাগুলি মধ্যে পড়ে আমার ভাতিজা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। আমরা এই হত্যার বিচার চাই। যে সকল আসামি মামলার বাইরে রয়েছে তাদের এই হত্যা মামলায় যুক্ত করা হোক।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট শামিম উল হাসান অপু বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যারা শহিদ হয়েছে তাদের হত্যার বিচার হওয়া খুবই জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যাদের জীবনের বিনিময়ে এই নতুন বাংলাদেশ তাদের হত্যার সাথে জড়িতদের বিচার হতে হবে।
এসময় তিনি আরও বলেন, যারা হত্যার সাথে জড়িত কিন্তু এজাহারে বাদ পড়েছে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করার আগে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময়ে নিহত-আহতের ব্যাপারে যে মামলাগুলো হয়েছে, সেসব মামলায় কিছু আসামি গ্রেফতার করা হয়েছে। আসামিরা বেশিরভাগই আত্মগোপনে থাকায় সবাইকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের কার্যক্রম চলছে।
উল্লেখ্য, আব্দুল্লাহ হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত এসআই সাহেব আলীকে ঐ দিনের পর আর এলাকায় দেখা যায়নি।
আব্দুল্লাহর পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এর পক্ষ থেকে আব্দুল্লাহর পরিবারকে কিছু আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে।
তবে এ সহায়তা অপ্রতুল। দরকার সংশ্লিষ্ট সকলের পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো।