বাসস
  ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১৬:১৯

কাজের সন্ধানে ঢাকা গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন শহিদ বাবু

॥ মনোজ কুমার সাহা ॥
টুঙ্গিপাড়া (গোপালগঞ্জ), ১৫ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস) : ভাগ্য ফেরানোর আশায় কাজের সন্ধানে ঢাকা গিয়েছিলেন দিনমজুর বাবু মোল্লা, ফিরলেন লাশ হয়ে। স্বামীকে হারিয়ে তিন শিশু সন্তান নিয়ে দিশেহারা শিল্পী বেগম এখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই ঢাকার রামপুরা এলাকায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন বাবু মোল্লা। 


বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ দিনমজুর বাবু মোল্লা (৩২) গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার গোহালা ইউনিয়নের দক্ষিণ গঙ্গারামপুর গ্রামের বাসিন্দা মরহুম মোঃ ফারুক মোল্লা ও জেসমিন বেগম দম্পতির পুত্র। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে বাবু মোল্লা বড়। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট দুই ভাইয়ের একজন মোটর শ্রমিক এবং একজন ইজিবাইক চালক। বাবু মোল্লার বাবা ছিলেন ভ্যানচালক। বছরের পর বছর প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করেই চলছিলো তাদের জীবন। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিলো স্ত্রী শিল্পী বেগমকে। পাঁচ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে। সেই টাকা শোধ করা হয়নি। ভেবেছিলেন ঢাকায় গেলে বেশি আয় করবেন, ঋণ শোধ করতে পারবেন। কিন্ত পুলিশের গুলিতে সব আশাই শেষ হয়ে গেলো। 


স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে তিন শিশু সন্তান নিয়ে শিল্পী বেগম (২৬) অথৈ সাগরে পড়েছেন। বাবু মোল্লা ও  শিল্পী বেগম দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলে।  রোজা মণি  (৮), ইয়ামিন মোল্লা (৬) এবং আয়েশা ইসলাম (৫ মাস)। স্বামীর কোন জমি বা সঞ্চিত অর্থ নেই। স্বজনরাও গরিব। বাবু মোল্লার নিজের কোনো বসত ভিটা নেই। তার ফুফুর ভিটায় ফুফুর করে দেয়া ঘরেই থাকতেন বাবু ও তার পরিবার। এখন বিধবা শিল্পী  শিশু সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিশেহারা।  


শহিদ বাবুর স্ত্রী শিল্পী বেগম বলেন, গ্রামে কাজ ছিল না। তাই কাজের সন্ধানে ১৫ জুলাই তিনি ঢাকার রামপুরা এলাকায় ছোট বোন রেশমা বেগমের কাছে যান। রেশমার স্বামী মাসুদ রানা তাকে ভাড়ায় অটো চালানোর ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে অটো চালানোর কাজ শুরু করেন বাবু।  ১৯ জুলাই রামপুরা টিভি সেন্টারের পাশে একটি মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে যান মাসুদ রানা। এ সময় বাবু মসজিদের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন । সেখানেই হঠাৎ তিনি গুলিবিদ্ধ হন।  গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে ১৯ জুলাই রাতেই তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। পরের দিন ২০ জুলাই সকাল ৭ টায় বোন জামাই মাসুদ রানা তার মরদেহ দক্ষিণ গঙ্গারামপুর গ্রামে নিয়ে আসেন। জানাজা শেষে গ্রামের কবরস্থানেই তার মরদেহ দাফন করা হয়। 


শিল্পী বেগম আরো বলেন, আমার শশুর মোঃ ফারুক মোল্লা ভ্যান চালক ছিলেন। আমার বাবা শহিদ মিয়া বরিশাল শহরে রিক্সা চালান। মা রওশন আরা বেগম জুট মিলের শ্রমিক। দেবর সোহেল মোল্লা মোটর শ্রমিক। আমরা সবাই খুব গরীব। আমার ফুফু শ^াশুড়ি কোহিনূর বেগম ঢাকায় থাকেন। তার জায়াগায় আমরা বসবাস করি।  আমাদের ছোট টিনের বসতঘরও ফুফু করে দিয়েছেন। এ ঘরটিও এখন জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। আমাদের নিজস্ব বসতভিটা নেই। এমনকি কোন কৃষি জমিও নেই। স্বামী কোন টাকা পয়সা রেখে যাননি।

গত ১৭ মে আমার ছোট মেয়ে আয়েশা পাশ^বর্তী মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট সেন্ট্রাল হাসপাতালে জন্ম গ্রহন করে। তখন সিজারিয়ান অপারেশনের সময় আমার স্বামী ৫ হাজার টাকা ঋণ করেন।   

তিনি জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর তাকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা দিয়েছে। এছাড়াও একটি এনজিও  এবং গ্রামবাসীর সাহায্য পেয়েছেন। তিনি এখন সন্তানদের মানুষ করার জন্য এলাকাবাসীর সহায়তায় তানভীর টেইলার্সের মালিক মোঃ নুরুজ্জামান মোল্লার দোকানে দর্জির কাজ শিখছেন। এখন একটা সেলাই মেশিন পেলে নিজেই আয় করতে পারবেন বলে জানান শিল্পী। 
তিনি বলেন, আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। 


বাবু মোল্লার  ছোট ভাই সোহেল মোল্লা বলেন, ২০০৯ সালে বরিশালে খান এ্যান্ড সন্স জুটমিলে শ্রমিক পদে চাকরি করার সময় বাবু বরিশাল শহরের কাউনিয়া এলাকার শহিদ মিয়ার মেয়ে শিল্পীকে বিয়ে করেন। তারপর তারা দক্ষিণ গঙ্গারামপুর গ্রামে চলে আসে। এখানে বসবাস শুরু করেন। গ্রামে এসে বাবু বাস চালকের সহকারির কাজ করত। ছয় বছর আগে এ কাজ ছেড়ে সে ভ্যান চালোনো শুরু করে। এরপর অটো চালিয়েছে। ছোট মেয়ের জন্মের সময় ৫ হাজার টাকা ঋণ নেয়। জুলাই মাসের দিকে তার হাতে কোন কাম-কাজ ছিল না। সংসারে আভাব-অনটন ছিল। তাই কাজের সন্ধানে গত ১৫ জুলাই তিনি ঢাকা যান। সেখানে অটো চালানো শুরু করেন। গত ১৯ জুলাই রাস্তায় দাঁড়িেেয় থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পোস্টমর্টেম ছাড়াই বাবুর মরদেহ গ্রামে আনা হয়। ভাইয়ের মৃত্যুর পর রাজনৈতিক দল ও এলাকাবাসী বাবু মোল্লার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোয় তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। 


শহিদ বাবুর প্রতিবেশি আমেনা বেগম বলেন,  এ মৃত্যু মর্মান্তিক। বাবুর মৃত্যুতে চারজন মানুষের ভবিষ্যত  অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। তাদের উপার্জনক্ষম কেউ নেই। তাই পরিবারটি পথে বসেছে।  নির্ভরতার ছাতা হয়ে সরকারকে এ অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। বাবুর আত্মত্যাগের মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই বাবুর আত্মা শান্তি পাবে। পরিবারটি বেঁচে যাবে। 


গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান বাসসকে বলেন, ‘আমরা বাবুর পরিবারের পাশে দাঁড়াব। তার পরিবারকে সব ধরণের সহযোগিতা প্রদান করব। তার স্ত্রীকে আমরা একটি সেলাই মেশিনের ব্যবস্থা করে দেব।’