বাসস
  ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১৪:১৪
আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:১৫

মাকে সাবধানে থাকতে বলে পাড়ি দিলেন না ফেরার দেশে

॥ ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন ॥

নাটোর, ১৬ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস) : মাকে সাবধানে থাকার কথা বলেছিলেন সোহেল। মা বেঁচে আছেন। কিন্তু সোহেল নিজেই চিরতরে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

অভাবের সংসারের হাল ধরতে পড়াশোনা ছেড়ে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন সোহেল।  বুকভরা আশা,  সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আনবেন। ছোট বোনটিকে পড়াবেন। মানুষের মতো মানুষ করবেন। সেই চেষ্টায় সাফল্যও পেয়েছিলেন। কিন্তু সংসারের  সেই শুকতারা নিভে গেছে। নিজের রক্ত ঢেলে নতুন করে লিখেছেন বাংলাদেশের নাম। অমরত্বের খাতায় শহিদ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন সোহেল রানা (২৬)।

গত ৫ আগস্ট বিকেলে যখন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয় ডংকা বাজছে, অন্যদিকে তখন ঢাকার বাইপাইল হয়ে উঠেছিলো রণক্ষেত্র। নিজের ভাড়া বাসার বারান্দায় রাস্তা থেকে ছুটে আসা গুলিতে শহিদ হন নাটোরের সোহেল রানা। তিনি তখন রাস্তার বিজয় মিছিল দেখতে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন।
 
সোহেলের চাচা জাহিদ হোসেন বাসসকে জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বাইপাইল থানার সামনে  সোহেল তার ভাড়া বাসার চারতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। সেখানেই তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন মেঝেতে। খবর পেয়ে তিনি এসে সোহেলকে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গত ৬ আগস্ট সকালে সোহেলের নিথর দেহ বাড়িতে পৌঁছায়। বাদ জোহর শোয়াইড় মাদ্রাসা ময়দানে হাজারো মুসল্লী জানাজার নামাজে সবটুকু ভালবাসা উজাড় করে বিদায় জানান সোহেলকে। শোয়াইড় গ্রামের কেন্দ্রীয় গোরস্থানে শহিদ সোহেল এখন চিরনিদ্রায় শায়িত।

তিনি বলেন, ‘পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে সোহেল রাত নয়টার দিকে মারা যায়। সোহেলের মত তরতাজা প্রাণ বুকের রক্ত দিয়ে নতুন করে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছে। আমরা তো সোহেলকে আর ফিরে পাব না। ওর রক্তে ভেজা বাংলাদেশ যেন ভবিষ্যতে সকলের জন্যে নিরাপদ হয়। আর যেন কারো রক্ত না ঝরে।’

নাটোরের চলনবিলের সিংড়া উপজেলার শোয়াইড় গ্রামের মতলেব আলী প্রামানিক (৫৪) ও রেহেনা বেগম (৪৮) দম্পত্তি’র পুত্র সোহেল রানা। তিন ভাইবোনের মধ্যে সোহেল দ্বিতীয়। বড় ভাই বাবার সাথে  ক্ষেতমজুরী করেন। সোহেল স্থাপনদিঘী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন সীমান্তবর্ত্তী নওগাঁর একটি ডিপ্লোমা ইন্সটিটিউটে। ইচ্ছে ছিলো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা কোর্স করবেন। কিন্তু পড়াশুনা করার টাকা নেই, বাড়িতে খাবার নেই। দুই ছেলে আর এক মেয়েসহ পাঁচজনের সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেই দিশেহারা মতলেব প্রামানিক। জমিজমা নেই বললেই চলে। তাই বড় ছেলে সাদ্দাম হোসেনকে সাথে নিয়ে  ক্ষেতমজুরের কাজ করতেন। সম্প্রতি শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন।  তাই বাড়ির পাশের মসজিদে সামান্য বেতনে মুয়াজ্জিনের চাকরি নিয়েছেন।

পরিবারের অভাব দূর করতেই সাত বছর আগে ঢাকার জিরানিতে নরবান গার্মেন্টসে অপারেটর পদে চাকরি নেন সোহেল রানা। এরপর বাইপাইলে বেক্সিমকো গার্মেন্টসে যোগ দেন। কর্মদক্ষতায় পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন সুপারভাইজার। বেতনও কম নয়। নিজের খরচ চালিয়ে প্রতি মাসে বাড়িতে পাঠান দশ হাজার টাকা। আদরের ছোট্ট বোন মিম খাতুন (১৬) আলোর দিশা খুঁজে পায়। পড়াশুনা শুরু করে সিংড়ার মদিনাতুল উলুম কওমী মহিলা মাদ্রাসায়। সাত বছরের ছোট্ট মিম এখন বিয়ের উপযোগী প্রায়। সোহেল টাকা জমাচ্ছিলেন, আদরের বোনকে ভালো ঘরে বিয়ে দেবেন। বাবা-মা, বড়ভাই আর বোনের হাসিভরা মুখের জন্যে, তাদের স্বাচ্ছন্দের জন্যেই যেন তার বেঁচে থাকা।

মা রেহেনা বেগম বাসসকে বলেন, গত ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে সর্বশেষ আমার সাথে কথা বলে সোহেল। বলে, ‘মা, এখানে খুব গন্ডগোল, গোলাগুলি হচ্ছে, দেশের অবস্থা ভালো না, তোমরা সাবধানে থাকো।’ আমাদেরকে নিরাপদ থাকার কথা বলে আমার সোহেল হারিয়ে গেল চিরতরে।
তিনি জানান, কোরবানির  ঈদে বাড়িতে আসাই ছিলো সোহেলের শেষ আসা। বাবা-মার কাছে  সোহেলের স্মৃতি এখন কোরবানির ঈদের আনন্দময় দিনগুলো।

মতলেব আলী প্রামানিক বলেন, ‘সংসারের হাল ধরা ছেলেকে হারিয়ে আজ আমরা দিশেহারা। সংসারের নিয়মিত ব্যয় নির্বাহসহ মেয়েটার পড়াশুনা ও বিয়ে অনিশ্চিত হয়ে গেল। সকলের কাছে দোয়া চাই, মহান আল্লাহ আমাদের সোহেলকে যেন শহিদি মর্যাদা দান করে জান্নাতের বাসিন্দা হিসেবে কবুল করেন। আর আমাদের পরিবারের সবাইকে ধৈর্য্য ধারণ করার তৌফিক দান করেন।’

সোহেলের বড় ভাই সাদ্দাম হোসেন (৩১) বলেন, ‘সোহেল মনের সব কথা উজাড় করে আমাকে বলতো। সব সময় আমার সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলতো। ও খুব প্রাণখোলা মানুষ ছিলো।’

সোহেলের শিক্ষক হাবিব মাস্টার বলেন, ‘ও খুব বিনয়ী আর পরোপকারী ছিলো’।

এদিকে শহিদ সোহেলের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা এবং স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ৫০ হাজার টাকার অনুদান দিয়েছে।

সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হা-মীম তাবাসসুম প্রভা বলেন, আগামীতেও সহযোগিতার ধারা অব্যাহত থাকবে।

চলনবিলের সাবেক সংসদ সদস্য এবং বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক কাজী গোলাম মোর্শেদ বলেন, সোহেল রানা দেশের জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন। এই জীবন উৎসর্গ আমাদের জন্যে গর্বের। ইতোমধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে শহিদ সোহেলের পরিবারকে এক লক্ষ টাকার অনুদান প্রদান করা হয়েছে। আগামীতেও দলের পক্ষ থেকে শহিদ সোহেল রানার পাশে থাকবো আমরা।