শিরোনাম
॥ শাহজাহান নবীন ॥
ঝিনাইদহ, ২১ অক্টোবর ২০২৪, (বাসস): বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ছিল ইমরান হোসেনের। সুদর্শন ইমরান হোসেন এখন অন্ধ হওয়ার পথে। দুশ্চিন্তায় ছেয়ে গেছে তার ভাবনার আকাশ। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ছোঁড়া গুলিতে চোখ হারাতে বসেছেন তিনি। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ঝিনাইদহ শহরের পায়রা চত্বরে গুলিবিদ্ধ আহতদের মধ্যে মো. ইমরান হোসেন (৩৬) অন্যতম। তার বাম চোখের ভেতরে এখনো দুটো রাবার বুলেট রয়েছে।
অন্ধত্বের আশঙ্কায় মূহ্যমান ইমরান হোসেন বেদনার্ত কন্ঠে বাসস’কে বলেন- ‘গত ৪ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন ঝিনাইদহ শহরের পোস্ট অফিস মোড়ে ছাত্রদের সঙ্গে সমাবেশে যোগ দিই। হঠাৎ সদর থানার গেট থেকে পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। ওই সময় আমার শরীরে ৩২টি রাবার বুলেট লাগে।’
তিনি বলেন, রাবার বুলেট লাগার পর আমাকে কে বা কারা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল আমার মনে নেই। আমি তখন অজ্ঞান ছিলাম। যখন জ্ঞান ফেরে, তখন দেখি আমি হাসপাতালের বিছানায়। ওই রাতে চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসি। হাসপাতালে ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজন আহতদের খুঁজে খুঁজে মারধর করছিল। তাই, অসুস্থ থাকা সত্বেও প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আমি বাড়িতে ফিরে আসি।
ঝিনাইদহ পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের ব্যাপারীপাড়ার ব্যবসায়ী আয়ুব হোসেন (৬০) ও আঁখি আক্তার (৫৫) দম্পতির পুত্র মো. ইমরান হোসেন। দুই ভাইবোনের মধ্যে ইমরান ছোট। তার বড় বোন ইমা আক্তার (৩৭) মৌলভীবাজারের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
মো. ইমরান হোসেনের স্ত্রী আইনজীবী নাজনীন পপি (৩৪)। ইমরান-পপি দম্পতির একমাত্র ছেলে মো. ইথান (৫)। ইথান ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। ইমরানের শ^শুর মৃত নাজিমুদ্দিন বিশ্বাস এবং শ্বাশুড়ি মোছা. মিলি (৫০)।
চোখের ভেতরে এখনো দুটো রাবার বুলেট রয়েছে জানিয়ে ইমরান বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের বিজয় মিছিলে আমি আহত অবস্থায় অংশ নিই। ঝিনাইদহ শহরের পায়রা চত্বরে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দিলে বিকাল সাড়ে ৬টার দিকে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম হিরণ (একই দিন গণপিটুনিতে নিহত) ছাত্র-জনতার ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে। ওই সময় আমার চোখে গুলি লাগে।’
মো. ইমরান হোসেনের স্ত্রী নাজনীন পপি (৩৪) জানান, ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে ডা. মেজবাহ আলমের কাছে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন ইমরান। চিকিৎসক অনেক আন্তরিকতা নিয়ে ইমরানের চিকিৎসা করছেন। ইমরানের বাম চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ডান চোখ নিয়েও শঙ্কায় ভুগছেন তার স্বজনরা।
আহত ইমরানের মা আঁখি আক্তার (৫৫) বাসস’কে বলেন, আমার ছেলের সামনে জীবনের বড় সময় পড়ে আছে। সে যদি চোখ হারিয়ে অচল হয়ে যায়, আমি মা হয়ে কীভাবে সেটা সহ্য করব? ছেলেটার মুখের দিকে তাকালে বুকটা ছিঁড়ে যায়।
অশ্রুসিক্ত নয়নে ইমরানের মা বলেন, ডাক্তারের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, আমার তো বয়স হয়েছে। আমার ছেলের জীবন কেবল শুরু। আমার ইমরানের চোখের ভেতরে দুটো গুলি। আমি আমার একটি চোখ আমার ছেলেকে দিতে চাই। আমি চাই, আমার চোখ দিয়ে হলেও যেন আমার ছেলে চোখের আলো ফিরে পায়।
আহত স্বামীর জন্য সকলের কাছে দোয়া চেয়ে নাজনীন আক্তার পপি বাসস’কে বলেন, ‘আমরা কোনো কিছু চাই না। চিকিৎসক বলেছেন, ইমরানের চোখের গুলি বের না করলে তার চোখটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সেই সামর্থ্য নেই।’
অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে নাজনীন আক্তার পপি আরও বলেন, আমার স্বামী তো মারাও যেতে পারতেন! কিন্তু আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে আছেন। এটাই অনেক পাওয়া। আমার স্বামীর উন্নত চিকিৎসার জন্য যদি কিছু করার থাকে, প্লিজ সেটা করুন। আমার বাচ্চাটা ছোট, সে তার বাবার কাছে এখন আগের মতো যেতে চায় না। বাচ্চাটা বলে, আব্বু অসুস্থ, আব্বুর কাছে গেলে আব্বু ব্যথা পাবে।
ইমরানের বাবা আয়ুব হোসেন (৬০) বলেন, আমার ছেলে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, এজন্য গর্ব হয়। তার চোখের ভেতরে গুলি আছে দুটো। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী চিকিৎসা করিয়েছি। চিকিৎসা এখনো চলছে। আমার ইমরানের চোখ ভালো করার জন্য বিদেশে নেয়া জরুরি। তিনি ছেলের চিকিৎসার জন্য প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন।
স্থানীয় একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানে স্বল্প বেতনে চাকরি করতেন ইমরান হোসেন। চোখে গুলি লাগার পর সেই চাকরি হারিয়েছেন। চোখে গুলি থাকায় মাথার তীব্র যন্ত্রণায় প্রায়ই নির্ঘুম রাত কাটান ইমরান। যন্ত্রণায় ছটফট করেন।
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. মেজবাহুল আলমের কাছে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন ইমরান হোসেন।
ডা. মেজবাহুল আলম বাসস’কে বলেন, রাবার বুলেটের আঘাতে ইমরানের বাম চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বাম চোখের কার্যক্ষমতা ৯০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে। আমরা সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ তবে বাম চোখের ক্ষতের কারণে ইমরানের ডান চোখের কোনো ঝুঁকি নেই বলেও জানান চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. মেজবাহুল আলম।
বিগত দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে ইমরান হোসেন বলেন, ‘আগে আমি কত প্রাণবন্ত ছিলাম। এখন চোখের আলো নিভে যাওয়ার ভয়ে থাকি সবসময়। চিকিৎসকের পরামর্শে বিশ্রামে আছি। কিন্তু এভাবে তো জীবন চলবে না। আমার ছেলেটা ছোট। বাবা-মায়ের বয়স বাড়ছে। সংসার কিভাবে সামলাবো যদি চোখ নষ্ট হয়ে যায়?’
গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিতে পেরে নিজেকে গর্বিত দাবি করে ইমরান বলেন, ‘আমার চোখ হারিয়েছে, তাতে আমার কষ্ট নেই। আমার চোখের বিনিময়ে হলেও অন্তত ফ্যাসিস্ট অত্যাচারী সরকারের পতন হয়েছে। রাজপথে ছোট ছোট শিক্ষার্থী ভাই-বোনদের ওপর পুলিশ ও শেখ হাসিনা সরকারের লোকজন যেভাবে নির্যাতন চালিয়েছে, তা মেনে নিতে পারিনি বলেই রাজপথে গিয়েছিলাম।’
এখন পর্যন্ত কোনো অনুদান পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ইমরান এই প্রতিবেদককে জানান, ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিস থেকে এককালীন ১০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছে। তবে আর কেউ খোঁজখবর নেয়নি। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগেই ইমরানের চোখের চিকিৎসা চলছে।
তবে প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলে ইমরানের চিকিৎসা করানো আরো সহজ হতো বলে মনে করে তার পরিবার।