বাসস
  ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১৪:৪৮

গুম হওয়া শহিদ হৃদয়ের দেহাবশেষ পাওয়ার আশায় পরিবার

॥ দিদারুল আলম ॥
ঢাকা, ২২ অক্টোবর ২০২৪(বাসস): কলেজ ছাত্র মো: হৃদয়। আর সকলের মতো তিনিও গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের আনন্দ মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। সেদিন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার আনন্দে রাস্তায় ঢল নামে হাজারো ছাত্র-জনতার।  পুলিশ আনন্দরত জনতাকে লক্ষ্য করে বর্বরোচিত হামলা চালায়। গুলিতে শহিদ হন হৃদয় ।
 
ঘটনাটি গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কোনাবাড়ী থানা এলাকার।
 
মো. হৃদয় (২০) টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার আলমনগর গ্রামের লাল মিয়া ও মোসাম্মাৎ রেহানা বেগম দাম্পতির একমাত্র পুত্র।  তিনি টাঙ্গাইল হেমনগর ডিগ্রী কলেজের ২০২১-২২ শিক্ষা বর্ষের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের হাল ধরতে হৃদয় গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় বড় বোন জেসমিনের বাসায় চলে আসেন। কোনাবাড়ী এলাকায় ভগ্নীপতি ইব্রাহিমসহ অটোরিকশা চালাতেন। পাশাপাশি পড়াশোনাও করতেন।

বোন জেসমিন বাসসকে বলেন, ‘আমার একমাত্র ভাই হৃদয়। আমরা দুই বোন। হৃদয় ঘটনার চার মাস আগে থেকে অটোরিকশা চালিয়ে বাড়িতে বাবা-মা ও পরিবারের জন্য টাকা পাঠাতেন। পাশাপাশি এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমার ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল ডিগ্রী পাস করবেন এবং ভালো একটি চাকরি পেয়ে পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল করে তুলবেন।’
 
আবেগ তাড়িত কন্ঠে জেসমিন বলেন, গত ৫ আগস্ট টেলিভিশনের খবরে এবং মানুষের মুখেমুখে শোনেন জনতার বিপ্লবের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে গেছেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে কোনাবাড়ী এলাকায় বিভিন্ন দল ও শ্রেণী পেশার মানুষ আনন্দ মিছিল বের করে। ওই মিছিলে আমার ভাই হৃদয় ও স্বামী ইব্রাহিমও অংশ নেয়।

তিনি আরো বলেন, এর আগে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে স্থানীয়দের সাথেও তারা মিছিলে গিয়েছিল।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আনন্দ মিছিল কোনাবাড়ী এলাকার শরীফ মেডিকেলের কাছে পুলিশের ধাওয়া ও গুলির মুখে পড়ে। মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। হৃদয় একটি গলিতে প্রাণরক্ষায় আশ্রয় নিতে গেলে সেখানে অলিগলির সকল দোকানপাট বন্ধ থাকায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায় সে। ঠিক তখনি বেশক’জন সশস্ত্র পুলিশ তাকে ঘিরে ধরে। কয়েকজন পুলিশ আমার ভাইয়ের হাতে ও শরীর ঝাপটে ধরে রাখে। এ অবস্থাতেই অন্য পুলিশ তাকে ব্রাশফায়ার করে। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তারতাজা তেজোদ্দীপ্ত স্বপ্নবাজ লড়াকু তরুণ হৃদয়ের গুলিবিদ্ধ দেহ। এর কিছুক্ষণ পর চারজন পুলিশকে হৃদয়ের হাত-পা ধরে তার গুলিবিদ্ধ দেহকে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।

হৃদয়কে পুলিশের গুলি করা ও তার গুলিবিদ্ধ দেহ নিয়ে যাওয়ার ভিডিও পরবর্তী সময়ে ভাইরাল হয়ে যায়।
 
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, হৃদয়কে পুলিশ জাপটে ধরার পরও টানা হেঁচড়া চলতে থাকে। ভিডিও ধারণকারী বা ভিডিও ধারণের আশপাশের কেউ বলছিল, দেখ ছেলেটিকে ভয় দেখানো হচ্ছে। ঠিক তখনই হৃদয়কে পুলিশ ব্রাশফায়ার বা গুলি করে।

বর্বরোচিত এ ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বোন জেসমিন। জেসমিনের মুখে শহিদ হৃদয়ের মর্মান্তিক হত্যার ঘটনা শুনে আবেগাপ্লুত হন বাসস প্রতিনিধিসহ উপস্থিত সকলেই।

হৃদয়কে পুলিশ গুলি করে থানায় নিয়ে গেছে এমন ঘটনা শুনে জেসমিনের স্বামী ইব্রাহিম সেখানে ছুটে যান। গিয়ে ইব্রাহিম তার আদরের শ্যালক হৃদয়ের গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ দেখতে পান। হৃদয়ের মরদেহ থানা থেকে আনতে পুলিশের কাছ বারবার অনুরোধ করেন। ইব্রাহিম মধ্য রাত পর্যন্ত থানা কম্পাউন্ডে অপেক্ষা করেও হৃদয়ের মরদেহ বুঝে পাননি। এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে শোক ও কষ্ট বুকে চেপে বাসায় ফিরে আসেন। পরদিন ৬ আগষ্ট সকালে কোনাবাড়ী থানায় গিয়ে দেখেন সেখানে কোন পুলিশ নেই, হৃদয়ের মরদেহও নেই। তারপর তারা গাজীপুরের বিভিন্ন হাসপাতাল, টঙ্গী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেলসহ আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে হৃদয়ের মরদেহ খোঁজ করেন। কিন্তু পাননি। কোনাবাড়ী থানা পুলিশ হত্যা করে থানায় নিয়ে হৃদয়ের মরদেহ একপর্যায়ে গুম করেছে বলে তার পরিবার দাবি করেছে। গত ৬ আগস্ট থেকে অন্তত দুই সপ্তাহ কোনাবাড়ি থানা পুলিশ শূন্য ছিল। ৫ আগস্ট রাত পর্যন্ত দায়িত্ব¡ পালন করা কোন পুলিশকে পরবর্তী সময়ে সেখানে আর দেখা যায়নি।
 
জেসমিন বলেন, ‘আমার বাবা-মা ও স্বজনরা এখনো আশাবাদী যে হৃদয়ের দেহাবশেষ পাওয়া যাবে। টাঙ্গাইলে গোপালপুরে গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে তাকে কবর দেয়া হবে।’
 
চোখের সামনে পুত্রের কবর থাকবে এ সান্ত¡না খুঁজে পাবার আশায় প্রহর গুনছে শহিদ হৃদয়ের পরিবার।

এদিকে ছেলেকে হত্যার বিষয়টি কিছুতেই মানতে পারছেন না মা মোসাম্মৎ রেহানা বেগম। তিনি এখনও ছেলের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ধরে ধরে কান্নাকাটি করছেন।
 
হৃদয়ের মা মোসাম্মৎ রেহানা বেগম বাসস প্রতিনিধিকে টেলিফোনে বলেন, ‘পরিবারের সচ্ছলতা ও নিজের পড়াশোনার জন্য হৃদয় কোনাবাড়িতে কাজ করতে গিয়েছিল। ১০ হাজার টাকা কিস্তি তুলে আমার বাবাকে দিয়েছিলাম গাড়ি চালানো শিখতে। আমার বাবা আর গাড়ি চালাবে না। সেই কিস্তির টাকা এখন কে দিবে? আমার বাবাটাকে  মেরে ফেলেছে পুলিশ গুলি করে। আমার ছেলের লাশ ফেরত দিন। আমি দেখবো একটি বার। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই।’

হৃদয়ের বাবা লাল মিয়া বলেন, ‘ঘটনার দিন তাকে বাড়িতে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু ছেলে বললো, ভাইয়ের (বোন জামাই) সাথে যাবো। আমরা বাবাটা আর আসলো না। আমরা বাবার লাশ ফেরত চাই।’

এদিকে শহিদ হৃদয়ের হত্যাকারী উস্কানিদাতাসহ সংশ্লিষ্টদের বিচারের দাবিতে নির্মম এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বরাবর ২১ অক্টোবর অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
 
জেসমিন বলেন, ‘আমরা আমার ভাইয়ের গুম হওয়া মরদেহ উদ্ধার এবং বর্বরোচিত এই হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’

তিনি বলেন, আমার ভাই হৃদয়কে হত্যার ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর টাঙ্গাইলের গোপালপুরে আমাদের বাড়িতে জেলার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার অনেকে এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া স্থানীয়রা খোঁজখবর নিয়েছেন।
 
তবে সরকারের দায়িত্বশীল কেউ কোন ধরনের খোঁজখবর এখনও পর্যন্ত নেয়নি। সাহায্য সহযোগিতার হাতও বাড়ায়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বাসস/এএসজি/ডিএ/১৪৩৫/-জুনা