বাসস
  ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১৬:২৭

ছোট সন্তানকে মানুষ করে শহিদ রিতার স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষা পরিবারের

জয়পুরহাট, ২২ অক্টোবর ২০২৪ (বাসস) : হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান রিতাকে নিয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিলো আকাশছোঁয়া। মেয়ে ডাক্তার হবে, সংসারের হাল ধরবে, অভাব পূরণ করবে।

সংসারের অভাব মেটাতে আর মেয়েকে ভালোভাবে পড়ালেখা করাতে সপরিবারে ঢাকায় গিয়েছিলেন রিক্সা শ্রমিক আশরাফ আলী।  কিন্তু ঘাতকের বুলেট তছনছ করে দিল সব। মাত্র একটি গুলিতেই শেষ হয়ে গেল রিতা আকতারের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। আর বাবা-মায়ের পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরে পাবার আশা।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ রিতা আকতার (১৭) অভাবি সংসারের হাল ধরতে চেয়েছিলেন। আরো চেয়েছিলেন ডাক্তার হতে। আর এ স্বপ্ন পূরণের আশায় ঢাকায় যান লেখাপড়া করতে। মিরপুর দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা শুরু করেন। কিন্তু মাঝপথে থেমে যায় তার স্বপ্নের গাড়ি। স্বপ্ন পূরণ করে নয়, রিতা বাড়ি ফিরলেন লাশ হয়ে। আর মেয়ের অকাল মৃত্যুতে শোকাহত পরিবার স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ফিরে এলো গ্রামে।

জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পুনট ইউনিয়নের তালখুর গ্রামের হতদরিদ্র আশরাফ আলী (৫২) ও রেহেনা বিবি (৪৫) দম্পতির কন্যা রিতা আকতার। তিন ভাইবোনের মধ্যে রিতা দ্বিতীয়। বড় ভাই রাকিবুল ইসলাম (২২) পেশায় দিনমজুর। ছোট ভাই রোকন ইসলাম (১১) স্থানীয় শান্তিনগর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। রিক্সা চালক স্বামীর একার আয়ে সংসারের প্রয়োজন মিটতো না। তাই রেহেনা বিবিও সেখানে গৃহকর্মীর কাজ নেন।

রিতার মা রেহেনা বিবি বেদনাহত কন্ঠে বাসসকে বলেন, ‘মেয়েকে আর ফিরে পাবো না জানি। কিন্তু আমার মেয়েসহ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত সকলেই যেন শহিদি মর্যাদা পায়। তাহলে মেয়েকে হারানোর বেদনা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।’

গ্রামের মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করে এ বছরই ঢাকার মিরপুর দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি  হন রিতা আকতার। মেয়ের লেখাপড়ার সুবিধার্থে পরিবারের সবাই ঢাকায় চলে যান। সেখানে তারা মিরপুর ২ মডেল থানার অধীন এইচ ব্লক ১০ নং রোড এলাকায় ভাড়া থাকতেন।

রেহেনা বিবি বলেন, গত ৫ আগস্ট সকালে স্বামী -স্ত্রী কাজে বের হয়ে যাই। এরপর বেলা ১০/১১ টার দিকে মেয়ে বের হয় ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিতে। দুপুরে বাসায় এসে দেখি মেয়ে নাই। একটু পরে গুলিতে আহত হওয়ার খবর পেয়ে মেয়েকে খুঁজতে যাই। মেয়েকে না পেয়ে বিভিন্ন স্থানে খুঁজতে শুরু করি।
ছাত্ররা জানায়, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কয়েকজনকে সেনাবাহিনীর গাড়িতে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নেওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে জানতে পারি আহতদের অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ করে রাত ১০ টার দিকে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ছুটে গিয়ে রিতার জামা কাপড় দেখে মেয়েকে শনাক্ত করি।

রিতার সহযোদ্ধারা জানায়, রিতার মাথার ডান পাশে গুলি লাগে আর বাম পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ রিতাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলেও সেখানে চিকিৎসা নিতে আশা অসংখ্য গুলিবিদ্ধ রোগী থাকায় চিকিৎসা সেবা পেতেও দেরি হয়ে যায়।
হাসপাতালের রেকর্ড অনুযায়ী, অজ্ঞাত হিসেবে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা ৬ টা ৫ মিনিটে রিতা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে মৃত্যু সনদ নিয়ে পরদিন গ্রামের বাড়ি ফেরেন বাবা মা। জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার তালখুর গ্রামের কবরস্থানে রিতাকে দাফন করা হয়।

জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই সামাজিক কর্মকান্ডে ঝোঁক ছিল রিতার। পড়াশোনার পাশাপাশি সুরেলা কন্ঠের কারণে মাদ্রাসার হামদ-নাত প্রতিযোগিতায় কয়েকবার প্রথম হয়েছেন। পুরস্কার পেয়েছেন অনেক।  পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। ২০২৪ সালে স্থানীয় ভূগোইল হেজবুল্লাহ দাখিল মাদ্রাসা থেকে বিজ্ঞান বিভাগে (৪ দশমিক ৭৮ পয়েন্টে) এ গ্রেডে পাশ করেন। তারপরই ঢাকায় গিয়ে মিরপুর দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন।
রিতা প্রায়ই তার বাবা-মাকে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নের কথা বলতেন। রিতা বলতেন, ‘আমি ডাক্তার হলে সংসারে আর অভাব অনটন থাকবে না।’
গ্রামেও আশরাফ আলীর নিজের জায়গা জমি নেই। অন্যের দেওয়া তিন শতাংশ জমিতে টিনের চালা দিয়ে কোন মতে খেয়ে না খেয়ে মাথা গুঁজে থাকতেন। সংসারের অভাব মেটাতে এবং ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করাতে ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালানো শুরু করেন তিনি ।

রিতার ছোট ভাই মোঃ রোকন ইসলাম বলেন, ‘আপু আমাকে খুব ভালোবাসতো।’
বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন রোকন।  বোনের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে নিজেও এখন আরো ভালোভাবে পড়ালেখা করবেন বলে জানান।

রিতার চাচাতো বোন সুমাইয়া খাতুন বাসসকে বলেন, মাদ্রাসায় যাওয়া-আসা, খেলধুলাসহ আমরা সবসময় সব কাজে  একসাথে থাকতাম। ওকে আর জীবনে পাব না ভাবতেই কষ্ট হয় ।
রিতার চাচাতো ভাই আবু বক্কর বলেন, ‘রিতা হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।’

ভূগোইল হেজবুল্লাহ দাখিল মাদ্রাসার সুপার আবদুল মনয়েম এবং গনিত বিষয়ের শিক্ষক ও প্রতিবেশী সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘রিতা আকতার আমাদের প্রিয় ছাত্রী ছিল। কোনদিন ওকে কারও সাথে খারাপ ব্যবহার বা ঝগড়া করতে দেখিনি। রিতাকে হারিয়ে ওর পরিবারের মতো আমরা এলাকাবাসীও শোকে কাতর। ইসলামী গান, হামদ, নাতে রাসুল বিষয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে কয়েকবার প্রথম হয়েছে রিতা। ওকে নিয়ে শিক্ষকদেরও অনেক স্বপ্ন ছিলো।’

এদিকে রিতা আকতারের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না মা রেহেনা বিবি। মেয়ের জন্যে এখনও তিনি তার কান্না থামাতে পারছেন না। প্রথমদিকে তিনি বার বার মুর্চ্ছা যেতেন। এখনও তিনি বিপুল শোকের সাগরে ভাসছেন।
তিনি বলেন, ‘রিতা ছিল অনেকের থেকে আলাদা। ওর মতো মেয়ে যার ঘরে থাকবে তারা অবশ্যই ভাগ্যবান হবেন। আমার মেয়ে কখনোই কোন অন্যায় করেনি। আমরা দুজনেই বাইরে কাজে গেলে সংসারের ছোট ছোট কাজ গুলো রিতা নিজেই করে ফেলতো।’

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ রিতার পরিবারে এখনও পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়নি বলে জানিয়েছে তার পরিবার। তবে কালাই পৌরসভার পক্ষ থেকে তার পরিবারকে ২০ হাজার টাকার অনুদান দেয়া হয়েছে। যদিও এ অনুদান একেবারে যৎসামান্য।
পরিবারটি দরিদ্র। এখন তাদের স্বপ্ন ছোট সন্তানকে মানুষ করা। তাকে মানুষ করার মধ্যদিয়ে তারা চান রিতার মাঝপথে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন পূরণ করতে। কিন্তু এ জন্যে যে অর্থ দরকার তা পরিবারটির নেই। এখন দরকার তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাহলেই হয়তো শান্তি পাবে রিতার আত্মা।