শিরোনাম
॥ মো: সাইফুল ইসলাম ॥
যশোর, ২৩ অক্টোবর ২০২৪ (বাসস) : যশোর শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে কেশবপুর উপজেলার ভাল্লুকঘর গ্রাম। কিছুটা পিচঢালা সড়কের পর ইট বিছানো পথ। তারপরই কাদা-মাটির রাস্তা মাড়িয়ে উত্তরপাড়া বিলের ধারে আব্দুল জব্বার মোল্যা ও রাশিদা বেগম দম্পতির ছোট্ট মাথা গোঁজার ঠাঁই। গাছ-গাছালিতে ভরা ছায়াঘেরা গ্রামটির এক প্রান্তে জব্বার মোল্যার বাড়ি। তার প্রতিটি কোনায় দারিদ্র্যের ছাপ।
এই দম্পতির ঘরে ছয় ছেলে-মেয়ের জন্ম। কিন্তু চারটি জন্মের পরপরই মারা যায়। বেঁচে থাকা দুই ছেলে জাহিদ হাসান ও তৌহিদুল ইসলাম রানাই ছিল তাদের স্বপ্ন পূরণের চাবি। গোছা থেকে আরো একটি চাবি হারিয়ে গেছে গত ৫ আগস্ট, গণঅভ্যুত্থানে।
স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের আনন্দে ভাসছে যখন পুরো দেশ, ঠিক সেই বিকেলেই আশুলিয়ায় পুলিশের গুলিতে নিভে যায় তৌহিদুল ইসলাম রানার (২৮) জীবন প্রদীপ।
জব্বার মোল্যার (৬০) বাড়ির উঠানে বসে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সাথে। তিনি বলেন, ‘মোবাইলে স্বৈরাচার বিরোধী লেখালেখি করতো। নিষেধ করতাম। বলতো, আল্লাহ ছাড়া কাউকেই ভয় পাই না। বাঘের মতো সাহস ছিল। একেবারে বাঘের বাচ্চা।’ তখন তার চোখের কোনায় পানি চিকচিক করছিল।
অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠ সামলে তিনি আরো বলেন, আন্দোলনের সময় রানা আশুলিয়া এলাকায় মিছিলে অংশ নিতো। চার তারিখেও আন্দোলনে রাস্তায় ছিল। কিছুক্ষণ পরপর ফোন দিত। মোবাইল ফোনে শুনতে পেতাম, ও শ্লোগান দিচ্ছে। চার তারিখেই ওকে নিষেধ করেছিলাম রাস্তায় নামতে। ও বলে, ‘সামনে বিপদ দোয়া করেন।’
তিনি বলেন, ৫ আগস্ট বেলা ১২টায় কথা হয় রানার সাথে। ও বলে, ‘ভাল খবর আছে, সেনাপ্রধান ভাষন দেবেন।’ বিকেল সাড়ে চারটায় তাকে ফোন দিলে ফোন রিসিভ করে। বুঝতে পারি আনন্দ মিছিল করছে, ও নেতৃত্ব দিচ্ছে। মাগরিবের পর রিং দিলেও রিং হয়, কিন্তু কেউ রিসিভ করে না। বারবার রিং দিয়ে না পেয়ে বড় ছেলেকে বলি। সেও খুঁজতে শুরু করে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ভোর চারটার দিকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রানার মরদেহ খুঁজে পায় জাহিদ। তার উরুতে গুলি লেগেছিল। কে বা কারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো সেটা আর জানা যায়নি। কিভাবে গুলি লেগেছিলো তাও জানা যায়নি।
স্বল্প বেতনের চাকুরিজীবী হতবিহ্বল জাহিদ প্রতিবেশিদের কাছ থেকে টাকা ধার করে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ৬ তারিখ সকাল ১০টায় ছোট ভাই রানাকে নিয়ে যশোরে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। দুপুর ২ টায় লাশ বাড়িতে পৌঁছালে সেখানে স্থানীয় মসজিদে নামাজে জানাজার পর ভালুকঘর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
রানার মা রাশিদা বেগম (৪৯) জানান, অভাব-অনটনের সংসারে বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেনি রানা। গ্রামে থাকা অবস্থায় ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছিল। ওর বড় ভাই জাহিদ ঢাকায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। সেই ছোটভাইকে ঢাকায় নিয়ে যায়।
রানার বড় ভাই জাহিদ বলেন, ঢাকায় এনে ওকে ক্লাস এইটে ভর্তি করিয়েছিলাম। কিন্তু পড়াশুনা করেনি। পরে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে দিয়েছিলাম। সবশেষ ইপিজেডে পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান পিকেডিএল-এ একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করছিল।
জানা যায়, জাহিদ ও রানা দুই ভাইই বিবাহিত। রানার বিয়ে হয় বছর চারেক আগে। তার দুই বছরের একটি কন্যা সন্তানও আছে। পরিবার নিয়ে দুই ভাই ঢাকাতেই থাকতেন। মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসতেন। মাসে মাসে বাবা-মার জন্য টাকাও পাঠাতেন।
রানার প্রতিবেশী ৭০ বছরের বৃদ্ধ আইউব আলী বলেন, রানাসহ ওদের পরিবারের সবাই খুব ভাল। সকলেই কঠোরভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতো। নিয়মিত তাবলিগে যেতো। অনেক ছোট বেলা থেকে বাবার সাথে রানাও তাবলিগে যেতো। তিনি বলেন, রানা মাঠের কৃষিকাজ তেমন একটা বুঝতো না। তবে নামাজ-রোজায় তার কোন গাফিলতি ছিল না। এলাকায় কারও সাথে কোন ঝুটঝামেলায় থাকতো না।
রানার চাচা জিয়াউর রহমান গাজী বলেন, ‘রানা কোনো দলীয় রাজনীতির সাথে কখনোই যুক্ত ছিল না। ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। বাপের সাথে তাবলিগে যেতো।’
জব্বার মোল্যা জানান, রানার মৃত্যুর পর মণিরামপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বাড়িতে এসেছিলেন। জেলা প্রশাসকও এসেছিলেন। তিনি ২৫ হাজার টাকা দেন। জামায়াতে ইসলামী ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে। এছাড়া তারা আর কিছু পাননি।
রানার বড় ভাই জাহিদ জানান, রানার মৃত্যুর পর ওর সন্তান আয়েশা (২)কে নিয়ে স্ত্রী নাসরিন আক্তার সাথী কুষ্টিয়ার মিরপুরে বাবার বাড়িতে থাকছেন। জামায়াতে ইসলামী তাকে দুই লাখ টাকা দিয়েছে বলে শুনেছেন জাহিদ। তবে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য রানার স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সরেজমিনে রানাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জব্বার মোল্যা বাড়ির মধ্যেই নিজের মতো করে ছোট্ট একটি মুরগীর খামার করেছেন। সেখানে ৯০টি দেশী জাতের মুরগি আছে। আর আছে দুটি ছাগল। এখান থেকে সামান্য কিছু আয় হয়। বাড়িতে তারা স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর কেউ থাকে না। এই দম্পতির ছয়টি সন্তানের মধ্যে এখন জীবিত আছেন কেবল একজন।
বাড়ির উঠানে প্রায় দুই ঘন্টা ধরে কথা হয় জব্বার মোল্যার সাথে। কথা বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠছিলেন। চোখ ভিজে যাচ্ছিল। ভাষা হারিয়ে ফেলছিলেন। বাঁধভাঙা চোখ দুটোকে লুকোতে বারবার পানি খাওয়ার জন্য ঘরের ভেতরে যাচ্ছিলেন। ভেঙে পড়া মুখচ্ছবি স্ত্রীকে দেখাতে চান না। কারণ রাশিদা বেগমের কষ্ট যে আরো বেশি। সন্তান হারানোর শোক কিছুতেই ভুলতে পারছেন না তিনি।
তাই জব্বার মোল্যা মুখ লুকাতে ব্যস্ত হচ্ছেন। কারণ জব্বার মোল্যা ভেঙে পড়লে রাশিদা বেগমকে সান্ত¡না দেওয়ার কেউ থাকবে না যে !