শিরোনাম
॥ বেলাল রিজভী ॥
মাদারীপুর, ২৩ অক্টোবর, ২০২৪(বাসস): মনিরুজ্জামান মোল্লা লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকুরি করতেন। তার আয় দিয়েই চলতো সংসারের খরচ। দেশের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করলেন তিনি। শহিদ হলেন। কিন্তু তার সংসারের চাকা গেলো অচল হয়ে। মনিরের মৃত্যুতে আর্থিক দুরাবস্থায় পড়লেন তার বাবা, মা ও স্ত্রী।
মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের শাখারপাড় গ্রামের মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মোল্লা এবং মনোয়ারা বেগমের ছেলে মনিরুজ্জামান মোল্লা(২৬)। মনিরুজ্জামান ঢাকার সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে পড়ালেখা করতেন। পাশাপাশি একটি জুতার কোম্পানিতে কাজ করতেন। বছর দুয়েক আগে বিয়ে করেন। স্ত্রী সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তেমন স্বচ্ছলতা না থাকলেও সংসারে সুখ ছিল। কিন্তু এখন সেখানে শুধুই দুঃখ ও হাহাকার।
হাসিনা সরকারের পতনের পর বিজয় মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন মনির। স্বৈরাচারের পতনে উল্লসিত ছিলেন তিনি। কিন্তু সে উল্লাস নিমেষেই রূপ নিল বিষাদে। আনন্দ নিয়ে নয়, বাড়ি ফিরলেন তিনি লাশ হয়ে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ডাকা মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন মনিরুজ্জামান(২৬)। মিছিলে থাকা অবস্থায় জানতে পারেন, সরকারের পতন হয়েছে। তখন মনিরুজ্জামান তাঁর বন্ধু মো.আলম কাজীকে নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন গণভবনে। উৎসুক জনতার সঙ্গে বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন তাঁরাও। কিন্তু এ আনন্দ নিয়ে ঘরে ফেরা হয়নি তাঁর। ঘরে ফিরেছেন লাশ হয়ে।
মনিরুজ্জামানের এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছে না তাঁর স্বজনরা। তাঁর স্ত্রী সামিরা ইসলাম সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীই ছিল তাঁর একমাত্র ভরসা। সামিরা বলেন, ‘আমার সন্তান এখনো পৃথিবীর আলো দেখেনি, তার আগেই ও বাবাকে হারাল। অনাগত সন্তান দেখবে না বাবার মুখ। এখন আমার সন্তান কাকে বাবা বলে ডাকবে? স্বামী ছাড়া এই দুনিয়াতে আমার আপন কেউ নাই। আমার স্বামীর কী দোষ ছিল? আমি কি আমার স্বামী হত্যাকারীদের বিচার পাবো না?’
মনিরুজ্জামানের পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট সকালে মোটরসাইকেল নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন মনিরুজ্জামান। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বন্ধু আলম। ঢাকায় গিয়ে তারাও অন্যদের দেখাদেখি গণভবনে যান। দুজনই লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বিজয় উল্লাস করে সন্ধ্যার আগে গণভবন থেকে বের হয়ে আসেন। পরে তাঁরা পুলিশ সদর দপ্তর সংলগ্ন ফুলবাড়িয়া এলাকায় গিয়ে একটি মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন।
নামাজ শেষ করার পর বের হয়ে দেখেন তাঁদের মোটরসাইকেলটি দৃর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যেই পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে শুরু হয় গোলাগুলি। পুলিশ ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। মনিরুজ্জামান ও আলম জীবন বাঁচাতে ছোটাছুটি করতে থাকেন। এ সময় মনিরুজ্জামান গুলিবিদ্ধ হন ও আলম মারধরের শিকার হন। পরে গুরুতর অবস্থায় দুজনকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। ওই দিন রাতেই মনিরুজ্জামান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
পরদিন ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় স্বজনেরা জানতে পারেন মনিরুজ্জামানের লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে রয়েছে। ওই দিন রাতে মনিরুজ্জামানের লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের শাখারপাড় মোল্লাবাড়িতে আনা হয়। পরদিন সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
মনিরুজ্জামানের কথা জিজ্ঞাসা করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর মা মনোয়ারা বেগম(৬০)। ছেলের কথা ভেবে এখনো বারবার মূর্ছা যান তিনি। বাবা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মোল্লাও (৬৫) বাকরুদ্ধ। কাঁদতে কাঁদতে মনোয়ারা বেগম বললেন, ‘আমার পোলাডারে গুলি কইরা মারছে, আমি কার কাছে এই কথা কমু? কার কাছে বিচার দিমু। আমার ছেলেডা ছোট হইলেও অনেক দায়িত্ব নিত। পোলাডা আমার মা-বাবা ছাড়াও বোনগো খেয়াল রাখত।’
কারো কাছ থেকে এখনও কোন সাহায্য সহযোগিতা পাননি বলেও জানান তিনি।
তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট মনিরুজ্জামান। বড় দুই ভাই অন্য শহরে আলাদা থাকেন। ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর পর বড় দুই বোনও বাবার বাড়িতে এসেছেন। বোন নুসরাত জাহান বলেন,‘আমার ভাইকে চারটি গুলি কইরা মারছে। বুকে, পিঠে, হাতে ও পায়ে চারটি গুলি করলে কেউ কি বাঁইচা থাকে?’
মনিরুজ্জামানের বন্ধু আলম কাজী বলেন, ‘আমরা গণভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ি। পতাকা হাতে নিয়ে ছবি তুলি। কত স্মৃতি আমাদের। ফেরার পথে ফুলবাড়িয়ায় যখন পুলিশের সঙ্গে লোকজনের সংঘর্ষ হচ্ছিল, আমরা তখন মাঝখানে পড়ে যাই। চারদিক থেকে তখন গুলির আওয়াজ। কিছু লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে আমাদের ওপর প্রথম হামলা চালায়। কিছুক্ষণ পরে দুজন দুদিকে সরে পড়ি। এরপর কিছু লোক আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে শুনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মনির (মনিরুজ্জামান) আর বেঁচে আর নেই। সেই দিনের কথা এখনো চোখে ভাসছে। বন্ধুর কথা ভীষণ মনে পড়ে। ওকে ভুলতে পারিনা কোনমতে।’
এদিকে মনিরুজ্জামান পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তার পিতা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। আয় রোজগার করতে পারেন না। এখন সংসারের খরচ চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে পরিবারটি।
মনিরের বৃদ্ধ বাবা মায়ের খরচ কে চালাবে? কে তাদের দেখবে?
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যদি কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে তাহলে বেঁচে যায় শহিদ মনিরের বাবা,মা। ঘুরে দাঁড়াতে পারে তার পরিবার।