বাসস
  ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:৪১

‘বাজান নেই, আমার সব শেষ’- এ আহাজারি শহিদ সাব্বিরের পিতার

॥ শাহজাহান নবীন ॥

ঝিনাইদহ, ২৩ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস): নিস্তব্ধতায় ঢেকে যাওয়া একটি বাড়ি। উঠোনে শুকানো হচ্ছে সোনালী ধান। ধান মেলে দিচ্ছেন যিনি, তাঁর চোখে জল। মুখে কাপড় চেপে ফিসফিস করে নিজের সঙ্গেই কি কি যেন বলছেন। ক’দিন আগেও এই বাড়িতেই ছিল প্রাণের মেলা। আজ এই বাড়িতে কেউ হাসে না। বাড়ির বাসিন্দাদের চোখে মুখে যে কষ্টের ছাপ, যে বেদনার ছায়া তা এক মহাশূন্যতার আভাস। বলছি, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের বীর শহিদ সাব্বির আহমেদের বাড়ির কথা।

গত ১৮ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে সাব্বির আহমেদ (২৩) ঢাকার উত্তরার আজমপুরে পানি ও শুকনো খাবার বিতরণ করছিলেন। ওই সময় পুলিশের গুলিতে তিনি শহিদ হন। সাব্বির আহমেদ উত্তরার একটি কোম্পানিতে অফিস সহকারি হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে।

আমোদ আলী মন্ডল (৬০) ও রাশিদা খাতুন (৪৮) দম্পতির প্রথম সন্তান ছিলেন সাব্বির আহমেদ। সাব্বিরের বাবা কৃষিকাজ করেন। মা গৃহিনী। তিন ভাইবোনের মধ্যে সাব্বির সবার বড়। তার আরো এক ভাই ও এক বোন আছে। সাব্বিরের বোন সুমাইয়া (১৯) পাশ^বর্তী শেখপাড়া দুঃখী মাহমুদ ডিগ্রি কলেজে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছোট ভাই সাদিক আহমেদ (১৭) ঝিনাইদহ শহরের একটি মাদ্রাসায় হেফজ বিভাগে পড়াশুনা করে।

সরেজমিনে শহিদ সাব্বিরের বাড়িতে গিয়ে চোখের পানি আটকে রাখা দায়। জীর্ণ-শীর্ণ আধা-পাকা বাড়ি। বাড়িতে সবকিছুই কেমন এলোমেলো। যে উঠোনে সাব্বির শৈশব, কৈশোরে হাঁটতে শিখেছিল, সেই উঠোন ভরা এখন হাহাকার।

সাব্বির আহমেদের মা কান্না জড়ানো কন্ঠে বলেন,‘বাবাগো, কি আর বলব। ১৮ তারিখ দুপুর থেকেই আমার বুকের ভেতরে কেমন যেন অস্থির লাগছিল। কোনো কারণ ছাড়াই ছটফট করে বেড়াচ্ছিলাম। সন্ধ্যায় খবর পেলাম, আমার বাজান (সাব্বির) আর নেই।’ 

অভাব অনটনের কারণে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর সাব্বির আর পড়তে পারেনি। সাত মাস আগে (মার্চ মাসে) ঢাকায় চলে যান সাব্বির। উত্তরায় একটি টাইলস কোম্পানির অফিসে স্বল্প বেতনে চাকরি নেন তিনি।

চোখের পানি মুছতে মুছতে সাব্বিরের বাবা আমোদ আলী মন্ডল বলেছেন, ‘১৭ তারিখ আমাদের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় সাব্বিরের। সে ফোন করে আমাদের খোঁজখবর নিয়েছিল। আমার সঙ্গে কথা শেষ করে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিল। আমরা তো বুঝতেই পারিনি, ওটাই হবে সাব্বিরের শেষ কথা।’ 
তিনি জানান, সাব্বির যে এলাকায় থাকত, তার আশেপাশেই তার মামাতো ভাই তরু (২২) থাকত। ১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে ছাত্র-জনতার ওপর নির্মম গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। ওই সময় সাব্বিরের গলায় গুলি লাগে। একপাশ দিয়ে গুলি লেগে তা অন্য পাশ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। আন্দোলনের সময় সাব্বির ছাত্রদের মাঝে পানি ও শুকনো খাবার বিতরণ করছিল। পুলিশ নিঁখুত নিশানায় তাকে গুলি করেছে বলে পরিবারের অভিযোগ।

গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টায় উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। 

সাব্বিরের বাবা আবেগাপ্লুত গলায় বাসস’কে বলেন- ‘প্রতিমাসে বাজান আমার হাতে ৫/৬ হাজার টাকা দিতো। তাই দিয়ে সংসার চালাতাম। সে অল্প বেতন পেতো, নিজের জন্য সামান্য কিছু টাকা রেখে বাকি সব বাড়িতে পাঠিয়ে দিতো। আজ বাজান নেই, আমার সব শেষ।’

তিনি আরও বলেন- ‘আমার টাকার দরকার নেই, আমার ছেলেটা যদি বেঁচে থাকত, আমার আর কিছুই লাগত না। কত কষ্ট করেছি, দিনরাত পরিশ্রম করেছি। আমার সাব্বির অভাবের জন্য পড়াশোনা করতে পারেনি। অল্প বয়সেই সে সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করেছে। আজ আমার বাজানকে কোথায় পাবো।’ এ সময় ডুকরে কাঁদতে থাকেন সাব্বিরের বাবা-মা।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে শহিদ সাব্বিরের মা রাশিদা খাতুন বাসস’কে বলেন- ‘তরু (সাব্বিরের মামাতো ভাই) প্রথম সাব্বিরের গুলি লাগার খবর দেয়। উত্তরার হাসপাতাল থেকে তরু আমার বাজানের লাশ বাড়িতে নিয়ে আসে। আমার ছোট ছেলে সাদিক (সাব্বিরের ছোট ভাই) আমার বাজানের জানাযা পড়িয়েছে।’

সাব্বিরের মা আরও বলেন- ‘৫ আগস্ট পর্যন্ত থানা থেকে পুলিশ ফোন করে নানা বিষয় জানতে চাইতো। এখন আর পুলিশ খোঁজখবর করে না। আমরা ৫ আগস্ট পর্যন্ত ভয়ে ছিলাম। ছেলেকে ওরা হত্যা করেছে, আবার আমাদের ভয়ও দেখাতো।’

শহিদ সাব্বিরের বাবা বাসস’কে বলেন- ‘আমাদের যা যাওয়ার তা তো চলেই গিয়েছে। আমার কলিজ¦ার টুকরো দুনিয়াতে আর নেই। আমি বাপ হয়ে এই কষ্ট কাউকে বুঝাতে পারি না। সারাদিন যে কাজই করি, সব সময় আমার সাব্বিরের মুখ আমার চোখে ভাসে। আমার প্রথম সন্তান। আমি কি করে এই কষ্ট সহ্য করি?’

অনুদান প্রসঙ্গে তিনি বাসস’কে জানান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্ররা সাব্বিরের পরিবারকে একটি গরু কিনে দিয়েছে। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামী দুই লাখ টাকা ও বিএনপির পক্ষ থেকে ৬২ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছে পরিবারটি। তবে এখন পর্যন্ত সাব্বিরের পরিবার সরকারি কোনো অনুদান পায়নি বলে দাবি সাব্বিরের বাবার।

সরকারের কাছে বিচার চেয়ে সাব্বিরের মা রাশিদা খাতুন বাসস’কে বলেন- ‘যারা আমার মতো হাজার হাজার মায়ের বুক খালি করেছে, তাদের বিচার যেন সরকার করে। আমি সন্তানহারা মা, আমি বুঝি এ কেমন যন্ত্রণার। আর কোনোদিন যেন দেশের মানুষের বুকে পুলিশ বা অন্য কেউ গুলি চালাতে না পারে, সেটাই আমাদের দাবি।’