শিরোনাম
॥ রফিকুল ইসলাম সুইট ॥
পাবনা, ২৪ অক্টোবর ২০২৪(বাসস) : হান্নানের স্বপ্ন ছিল ছেলেকে ডাক্তার ও মেয়েকে বিমান বাহিনীর অফিসার বানানোর। তাদেরকে মানুষের মতো মানুষ করার। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণের আগেই তাকে চলে যেতে হলো অচেনা এক পৃথিবীতে। সন্তানদের শিক্ষিত করা, মানুষের মতো মানুষ করা কোনটাই আর দেখে যেতে পারলেন না তিনি। মুহূর্তেই পুলিশের বুলেট সব ল-ভ- করে দিল। তছনছ হয়ে হলো একটি সাজানো পরিবার।
আব্দুল হান্নান খান বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ৫ আগষ্ট পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। গুলি লাগার পর ছেলেকে বলেছিলেন, ‘সিফাত গুলি ম্যারে(মেরে) দেছেরে(দিয়েছে)’। তারপর সিএনজি’র মধ্যে ছেলের শরীরের ওপর নিস্তেজ হয়ে পড়েন।
কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো জানিয়েছেন শহিদ আব্দুল হান্নানের মেডিকেল পড়–য়া ছেলে সাইফ আহমেদ খান(সিফাত)।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার কাশিনাথপুরের ইদ্রাকপুর গ্রামের মৃত শহীদুর রহমান ও মৃত সাজেদা বেগমের ছেলে আব্দুল হান্নান খান(৫৭)। স্ত্রী শিরিন আকতার, একমাত্র ছেলে কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সাইফ আহমেদ খান( সিফাত) ও একমাত্র মেয়ে বিএএফ শাহীন কলেজের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী সায়মা আকতার ¯িœগ্ধাকে নিয়ে ছিল সুন্দর সুখী পরিবার। শহিদ হান্নান বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে এসইএম ইমপ্লয়ী (চার্জহ্যান্ড) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।(সার্ভিস নম্বর ১৩০০৭৭, কার্ড নম্বর ইএস/২৩০০০১২৮)।
গত ৫ আগষ্ট কর্মস্থল ঢাকা সেনানিবাস থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে ছেলের সাথে মিরপুর ১৩ এর বাসায় ফিরছিলেন তিনি। সন্ধ্যা ৭ টার আগে কাফরুল থানার সামনে স্টাফ কোয়ার্টারের পাশে পৌঁছালে ১৫/২০ জন পুলিশ তাদেরকে দেখে বকাঝকা শুরু করে এবং জানতে চায় তারা কেন বের হলো। এক পর্যায়ে পুলিশ ৪০/৪৫ ফিট দূর থেকে হান্নান ও তার ছেলেকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। ছেলে মোটরসাইকেল থেকে নেমে পড়ায় বেঁচে যান। হান্নান বন্দুকের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েন। এর প্রায় ১৫ মিনিট পরে সিএনজিতে করে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মরদেহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে রাখা হয় এবং এরপর ৭ আগষ্ট শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে পাবনায় গ্রামের বাড়ীতে লাশ নিয়ে আসা হয়। এরপর ৮ আগষ্ট সকাল ৯ টায় জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন করা হয়।
শহীদ হান্নানের মেডিকেল পড়–য়া ছেলে সাইফ আহমেদ খান সিফাত জানান, ঐদিন সাধারণ ছুটি থাকলেও বাবাকে অফিসে যেতে হয়। অফিস থেকে বিকেলে ফেরার সময় আমাকে খবর দিলে আমি বাবাকে আনতে এগিয়ে যাই। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে ৭ টার দিকে কাফরুল থানার সামনে স্টাফ কোয়ার্টারের পাশে পৌঁছালে ১৫/২০ জন পুলিশ আমাদের পথরোধ করে জানতে চায় আমরা কেন বের হলাম। বাবা পরিচয় পত্র দেখান। আমি ভয় পেয়ে নেমে পড়ি আর বাবা গাড়ী ঘোরানোর চেষ্টা করেন। এ সময় ৪০/৪৫ ফিট দূর থেকে বাবা কে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে পুলিশ। বাবা গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েন। আমি পাশেই চিৎকার করতে থাকি। তখন বাবা বলে, ‘সিফাত গুলি ম্যারে দেছেরে’। বাবার তলপেটে বাম পাশে গুলি লেগে পিছন সাইড দিয়ে বের হয়ে যায়। বাবা গুলি খেয়ে ছটফট ছটফট করতে থাকেন। আমি চিৎকার করায় স্টাফ কোয়ার্টারের লোকজন বেরিয়ে আসে। একটি গামছা দিয়ে গুলি লাগা স্থান বেঁধে দেয়। প্রায় ১৫ মিনিট পরে সিএনজিতে উঠিয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়ার সময় আব্বা আমার শরীরের ওপর নিস্তেজ হয়ে পড়েন। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। হাসপাতালে পৌঁছালে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।
সিফাত বলেন, আব্বাসহ আমাদের পরিবারের সবাই আন্দোলনের পক্ষে ছিলাম। পরিবারের একমাত্র উপাজর্নক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আব্বা। আমরা এখন অর্থনৈতিক সমস্যায় দিশেহারা। আমদের ভীষণ অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। আমার বাবার শহিদী মর্যাদা, আন্দোলনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং খুনিদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি চাই।
শহিদ হান্নানের স্ত্রী শিরিন আকতার বলেন, গত ৫ আগষ্ট সন্ধ্যায় আমি আমার স্বামীকে ফোন করলে আমার ছেলে ফোন ধরে জানায় যে বাবা গুলিতে আহত হয়েছে, হাসপাতালে নিচ্ছি। আমি হতভম্ভ হয়ে পড়ি। পরে হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার স্বামী আর নাই। আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ ছিলেন। বাবা মায়ের এবং এলাকাবাসীর ভক্ত ছিলেন। বাড়ী গেলে গরীব মানুষের যতটুক পারুক সহযোগিতা করতেন। গবীর মানুষের সহযোগিতা করার মানসিকতা ছিল প্রবল। এলাকার মানুষ ঢাকায় আসলে যতদুর সম্ভব সহযোগিতা করতেন। আমি আমার স্বামীর শহিদী মর্যাদা চাই। তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। মেডিকেল পড়–য়া ছেলে এবং স্কুল পড়–য়া মেয়ের পড়ার খরচ, বাসা ভাড়া নিয়ে ভীষণ অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়েছি। সহযোগিতা না পেলে ছেলে মেয়ের পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমাদের স্বপ্ন ছিল, ছেলেকে ডাক্তার ও মেয়েকে বিমান বাহিনীর অফিসার বানানো।
পাবনা সিভিল সার্জন অফিসে কর্মরত শহিদ হান্নানের ভাই মো. রোকনুজ্জামান লিটন জানান, আমার ভাই শহিদ আব্দুল হান্নান খান একজন সৎ এবং পরোপকারী মানুষ ছিলেন। কর্ম ব্যস্ততায় ঢাকায় থাকলেও এলাকার মানুষের সাথে ছিল নিবিড় সর্ম্পক। কোন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ভাই প্রায়ই বলত, ‘আমি ছোট চাকুরি করলেও আমার সন্তানদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলব, বড় অফিসার বানাবো’। তিনি হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।
একইসঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে অসহায় হয়ে পড়া পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
শহিদ হান্নান ছেলে মেয়েকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা পূরণে দরকার সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে আর্থিক সহায়তা। তা না পেলে এ দুটি ছেলে মেয়ের ভবিষ্যত অন্ধকার পথে হারিয়ে যেতে পারে। শহিদ হান্নানের স্বপ্ন পূরণে দরকার তাদের পাশে থাকা। আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা। তাহলেই হয়তো শান্তি পাবে শহিদ হান্নানের অতৃপ্ত আত্মা।