শিরোনাম
॥ মোঃ আব্দুর রাজ্জাক ॥
কুষ্টিয়া, ২৪ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস): আশরাফুল ইসলাম পেশায় রংমিস্ত্রি ছিলেন। কিন্তু মানুষের অধিকার আদায়ে বরাবরই ছিলেন সচেতন। তাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন শুরু হলে তিনিও সোচ্চার হয়ে ওঠেন। নামেন রাস্তায়। বাসায় না জানিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈরাচার সরকারের পতন আন্দোলনে শরীক হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবন দিতে হলো আশরাফুলকে। খাওয়ার কথা বলে গিয়ে জীবিত আশরাফুল আর ফিরে এলো না বাড়ি।
চলতি বছরের জুলাই মাসের শুরু থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিলে এর ধারাবাহিকতায় কুষ্টিয়াতেও আগস্ট এর শুরু থেকেই তা প্রকট আকার ধারণ করে। গত ৫ই আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটলেও দিনটির ভোর বেলা থেকেই ছাত্র জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যায় পুলিশ। কুষ্টিয়ার প্রাণকেন্দ্র এনএস রোড হয়ে ওঠে রণক্ষেত্র। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমন করতে বুলেট, টিয়ার সেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ। শুধু ৫ই আগস্টই পুলিশের গুলিতে শহিদ হয় ৯ জন। এদেরই একজন দুই সন্তানের পিতা, রংমিস্ত্রি আশরাফুল ইসলাম(৪৮)।
কুষ্টিয়া চার রাস্তার মোড়ে দুপুর ১২ টায় পুলিশের ঘাতক বুলেটের আঘাতে শহিদ হন তিনি। আশরাফুল ইসলাম কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুরের সালদা গ্রামের আফিল উদ্দিন এবং মোছাম্মৎ নাজমা খাতুনের ছেলে।
অনেক প্রাণের বিনিময়ে দেশ আজ স্বৈরাচার মুক্ত। কিন্তু পরিবারের একমাত্র উপার্জন করা মানুষটিকে হারিয়ে তার স্ত্রী ও সন্তান এখন দিশেহারা অবস্থায়। স্ত্রী লাবনী আক্তার ইতি, ছেলে ফাহিম মাহমুদ প্রাণ (১০) ও মেয়ে ফারিহা তাবাসসুম ফারাহকে(৪) নিয়ে আশরাফুলের যে সুখের সংসার ছিল তাতে নেমে এসেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ঘোর অন্ধকার।
ফারিয়া তাবাসসুম ফারাহ চার বছরের শিশু। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হারিয়েছে পিতাকে। মৃত্যু কি বিষয় বোঝার বয়স না হলেও বাবার অনুপস্থিতি ছোট্ট মনে ফেলেছে বিরূপ প্রভাব। তাইতো শিশু মন পিতার মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না । সে কবর থেকে বাবাকে উঠিয়ে গুলি বের করে বাঁচিয়ে তুলতে চায়। সাথে পিতার হত্যার সাথে জড়িত পুলিশের বিচারও চায় সে।
এদিকে ফাহিম মাহমুদ প্রাণ বৃষ্টির পানিতে বাবা ভিজে যাবেন এই ভয়ে প্রতিদিন ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন বাবার কবরের পাশে। বাবার পুরাতন ছবি আর মোটরসাইকেল নিয়েই দিন কাটে তার।
আশরাফুলের আয় রোজগারে কোন মতে সংসার চললেও এখন একেবারেই থমকে গেছে সব। মানুষের সাহায্যে বর্তমানে কোনরকমে চলছে তাদের সংসার। কিন্তু এভাবে কতোদিন চলবে? তাই আশরাফুলের স্ত্রী দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন। তবে শত কষ্টের মাঝেও স্বামী দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে শহিদ হয়েছেন এটাই তার বড় পাওয়া বলে তিনি জানিয়েছেন।
আশরাফুলের স্ত্রী লাবনী আক্তার ইতি অশ্রুসিক্ত নয়নে বাসস কে বলেন, ‘গত ৪ ই আগস্ট আমার স্বামী কাউকে না জানিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যায়। আমি বাধা দেবো বলে ৫ আগস্ট আমাকে ভাত রান্না করতে বলে বাইরে যায়। যাওয়ার সময় বলে যায় এসে খাবো। কিন্তু আর একসাথে খাওয়া হলো না। পুলিশ খুব কাছ থেকে গুলি করে । মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও পুলিশ একের পর এক লাথি মারতে থাকে। এমন একটি ভিডিও আপনারা সবাই দেখেছেন। কি অমানবিক ভাবে তাকে হত্যা করলো। আমি আমার ছেলে মেয়েদের কি করে মানুষ করবো। ওদেরকে আমি বোঝাতে পারি না। এখনও সরকারের কাছ থেকে কোন সাহায্য সহযোগিতা পাইনি।’
মেয়ে ফারিয়া তাবাসসুম ফারাহ বলেন, ‘আমি বাবার শরীর থেকে গুলি বের করে ভালো করে তুলবো। পুলিশ কেন আমার বাবাকে গুলি করলো? এখন আমাকে কেউ কোলে নেয় না। আদর করে না। আমার বাবা আকাশের তারা হয়ে গেছে’।
আশরাফুলের ছেলে ফাহিম মাহমুদ প্রাণ এ প্রতিবেদককে বলেন,‘এখন বৃষ্টি নামবে, আব্বুর কবরের পাশে যাবো। ছাতা না নিলে ভিজে যাবে আব্বু। আমার আব্বুকে ওরা গুলি করে মেরে ফেলেছে।’
স্বজনরা জানান, ‘দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করা আশরাফুলের পরিবারের জন্য সকলের এগিয়ে আসা উচিত। এতে একটি পরিবার যেমন পাবে আলোর দিশা অন্যদিকে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা আশরাফুল বেঁচে থাকবে মানুষের হৃদয়ে।