বাসস
  ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১৩:৩৯

ছেলে নেই, সাইকেলের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে কাঁদেন পিতা

॥ সাজ্জাদ হোসেন ॥

ঢাকা, ২৭ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস) : ইদানিং নিজেকে অনেক বড় ও দায়িত্বশীল ভাবতে থাকে সৈকত। বাবার বয়স হয়েছে, সে আর এতো কষ্ট নিতে পারছে না। সন্তান হিসেবে তাকেই  তো সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব একটা কিছু করতে হবে। কিন্তু কিছুই আর করা হলো না সৈকতের। করতে দেয়া হলো না তাকে। করতে দিলো না ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেট।

সৈকতের জীবনটা শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে।

কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন, কোটাসংস্কার আন্দোলনে গত ১৯ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহিদ মাহামুদুর রহমান সৈকতের বড় বোন শাহরিনা আফরোজ সুপ্তি(২৬)।

সৈকতের পিঠাপিঠি বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তি(২৩) ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করে বললেন, ‘কতটুকুই বা বয়স হয়েছিল আমার ভাইটির? কলিজার টুকরা ভাইটির ইচ্ছা ছিল কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। হতে চেয়েছিল অনেক বড় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু ঘাতকের একটা বুলেট তার সকল স্বপ্ন-সাধ কেড়ে নিল। মৃত্যুতেই সকল আশা-আকাক্সক্ষা আর ইচ্ছার অবসান হলো।’

একটু থেমেই তিনি আবার বললেন, ‘জানেন, আমার ভাইয়ের মাথার একদিক থেকে গুলি ঢুকে অন্যদিক দিয়ে মগজসহ বেরিয়ে গেছে। সাথে সাথেই সব শেষ। মাথায় গুলি না করে শরীরের অন্য জায়গায় করলে কি হতো? শরীরের অন্য কোথাও গুলি লাগলে হয়তো পঙ্গু হয়েও আমাদের ভাইটি চোখের সামনে বেঁচে থাকতো।’

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের ভাড়া বাসায় সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় এই শহিদ পরিবারের সদস্যদের। টগবগে, উচ্ছল, স্বপ্নবাজ সন্তানকে হারিয়ে মা-বাবা যেন নির্বাক হয়ে গেছেন। ভাইকে হারিয়ে দুই বোনও নিস্তব্ধ। স্বজন হারানোর শোকে পাথর হয়ে যাওয়া পরিবারের কারো মুখে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন কথা নেই। প্রায় ৩ মাস ১০ দিন চলে গেলেও নিজেদের স্বাভাবিক করতে পারেননি পরিবারের সদস্যরা।

সৈকতকে যে পুলিশ অফিসার গুলি করেছিল তাকে শনাক্ত করা গেছে উল্লেখ করে সেবন্তি জানান, “মোহাম্মদপুর রায়ের বাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম আমার ভাইকে গুলিটা করেছে। গুলি করার পর তাকে উপস্থিত জনতা জিজ্ঞেস করেছিল- ‘ছেলেটাকে কেন গুলি করলেন’? তখন সে বলে- ‘দেখছেন না, ডিস্টার্ব করতেছিল’।”

তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের হত্যাকারী এখনো গ্রেফতার হয়নি, মামলারও তেমন কোন অগ্রগতি নেই। আমরা চাই আমার ভাইয়ের হত্যাকারী যেন মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াতে না পারে। তার যেন বিচার হয়। তবে কোন নিরপরাধ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন এটাও চাই।’

শহিদ সৈকতের মা আফরোজা রহমান(৪৫) বলেন, আন্দোলনের শুরু থেকে তার মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করতো সব সময়। বলতো- ‘এতো শিক্ষার্থী মারা যাচ্ছে, আর আমি অথর্ব, বাসায় বসে আছি কিছুই করতে পারছি না’। আমাদের বাধার কারণে আন্দোলনে যেতে পারতো না, এজন্য ১৮ জুলাই খানাপিনা ছেড়ে দিয়ে অনশনও পালন করে।

‘এমনিতে সে কখনো মায়ের হাতে খাবার খেতো না। কিন্তু ওইদিন সন্ধ্যায় মায়ের হাতে খাবার খেয়ে অনশন ভাঙে’ বলেন শাহরিনা আফরোজ সুপ্তি।      

মাহামুদুর রহমান সৈকত ১৯ বছর বয়সী। কাকতালীয়ভাবে শহিদ হন ১৯ জুলাই। ঢাকাতেই ২০০৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তার জন্ম। দুই বোনের একটি মাত্র ভাই। সে ছিল সবার ছোট। সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এবার বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অনার্সে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এসএসসিও পাস করেন একই প্রতিষ্ঠান থেকে। সৈকত ছিলো লাজুক, শান্ত স্বভাবের অন্তর্মুখী চরিত্রের অধিকারী। ক্রিকেট পাগল ছিল সৈকত। ঘরে আজও পড়ে রয়েছে তার প্রিয় ব্যাট-বল। সাইকেল চালানোও প্রিয় শখ ছিল সৈকতের। বাবা আজও  তার সাইকেলটি ধুয়ে মুছে রাখেন। সাইকেলের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। কাঁদেন একা। ছেলে নেই। বিড় বিড় করে কথা বলেন সাইকেলের সাথে। সৈকতের যতো দুষ্টুমি ছিল পরিবারের সদস্য ও বন্ধু মহলে, বাইরের মানুষের তা বুঝার কোন উপায় ছিল না। দুই বোনের মধ্যে সেবন্তির সঙ্গেই সৈকতের সখ্য ছিল সবচেয়ে বেশি।

‘আমরা দুই বোন ছোট ভাইকে পাখির মতো আগলে রেখে বড় করেছি। আদর করে ভাইকে আমরা টুনা, টুনাপোকা এসব বলে ডাকতাম। তবে দুই বোনের মধ্যে আমার সাথে ভাব-ভালবাসাও বেশি ছিল, আবার ঝগড়াঝাটিও হতো বেশি। কারণ আমরা দু’জন ছিলাম পিঠাপিঠি বয়সের, বললেন সেবন্তি।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে বেলা ৩টা ৩৭ মিনিটের দিকে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন মাহামুদুর রহমান সৈকত। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে সৈকত রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। আন্দোলনকারীদের কয়েকজন ধরাধরি করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে স্বজনেরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে মাহামুদুরের মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা রক্তাক্ত লাশ পেয়েছিলেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা ছিল ‘গান শট’। হাসপাতাল থেকে সরাসরি মোহাম্মদপুরের মারকাজুল ইসলামে নিয়ে গোসল দিয়ে সেখানেই লাশ রাখা হয়। সেদিন আর বাসায় আনা হয়নি। পরদিন সৈকতকে মোহাম্মদপুর জামে মসজিদ কবরস্থানে দাফন করা হয়।   

নূরজাহান রোডে বাসার কাছেই মাহামুদুর রহমানের বাবা ৬৪ বছর বয়সী মাহাবুবের রহমানের ‘দই ঘর’ নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। ছেলে তাকে ব্যবসায় সহায়তা করতেন। দোকানে বসতেন। ১৯ জুলাই মাহাবুবের রহমান পারিবারিক কাজে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ছিলেন। সেদিনও সৈকত দোকানে গিয়েছিল। কিন্তু একটু পরই আবার ফিরে এসে তার এক বন্ধু গুলিবিদ্ধ হয়েছে জানিয়ে  নামাজরত মাকে ডেকে বলেই বেরিয়ে যায়। এটাই তার শেষ যাওয়া।   
সেবন্তি জানান, তার ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা দোকানে গেলেও সেখানে বসেই কান্নাকাটি করতে থাকেন। দোকান থেকে ভাই যে জায়গায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে, সেই জায়গায় গিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকেন।

সেবন্তি জানায়, ‘সৈকত একটা বিড়াল পালতো। সে মারা যাওয়ার পর বিড়ালটা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। অনেক কষ্ট করে তাকে খাওয়াতে হয়েছে। এখনো হঠাৎ এদিক-সেদিক দৌড় দেয় আর মিও...মিও করে ডাকে আর খুঁজতে থাকে।’

সৈকতের স্কুল জীবনের বন্ধু মো. জারিফুর রহমান বলেন, ‘সৈকতের মতো সম্ভাবনাময় ছাত্র হত্যাকারীদের বিচার হওয়া উচিত। ওইদিন আমিও আন্দোলনে ভিন্ন স্পটে ছিলাম। তার গুলি লাগার ফোন পাই ৪টা বাজার একটু আগে। ছাত্ররা আন্দোলন করবে, সরকার চাইবে আন্দোলন থামাতে। কিন্তু এই আন্দোলন থামানোর প্রক্রিয়াটাতো মানুষ মেরে হতে পারে না।’   

সৈকতের আরেক বন্ধু বায়েজিদ বলেন, ‘সৈকত ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। বন্ধুদের মধ্যে সে ছিল সাদাসিদা মনের, পরোপকারী, নিরহঙ্কারি ও সুখী মানুষ। কোন বিষয়ে তার কপটতা ছিল না। বন্ধুদের যে কোন বিপদে সে ঝাঁপিয়ে পড়তো। অসুস্থদের প্রয়োজনে নিজের রক্ত দিয়ে সাহায্য করতো। সেবামূলক যে কোন কাজে সকলের আগে ঝাঁপিয়ে পড়তো সে। আমি সৈকতসহ যত মানুষ মারা গেছে, প্রত্যেকের হত্যার ন্যায্য বিচার চাই।’  

গত ২৫ আগস্ট শহীদ মাহামুদুর রহমানের বাবা বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় ছেলের হত্যাকা-ের ঘটনায় মামলা করেছেন। আর ৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেছেন। এ মামলায় এ পর্যন্ত ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।

তবে মামলার অগ্রগতি কম বলে অভিযোগ রয়েছে পরিবারের।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রথম দিকে যে কয়জন শহিদ হয়েছেন সৈকত তার অন্যতম। তাদের ঝরানো রক্তের নদী পাড়ি দিয়েই দেশ আজ স্বৈরাচারমুক্ত। তাই হত্যাকারীদের অতিদ্রুত বিচারের আওতায় আনা খুবই জরুরি বলে মনে করছেন সকলেই।