শিরোনাম
॥ ইসমাঈল আহসান ॥
ঢাকা, ২৯ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস) : এদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি বিশেষ দিক ব্যাপক হারে মেয়েদের অংশগ্রহণ। চলতি বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রথম যে মেয়েটি শরীরের তাজা রক্ত ঢেলে দিল তার নাম নাঈমা সুলতানা। বয়স ১৫ বছর।
রংপুরে ১৬ জুলাই আবু সাঈদকে হত্যার মধ্যদিয়ে আন্দোলন নতুন বাঁক নেয়। আন্দোলন যখন তুঙ্গে পুলিশও তখন তীব্র মারমুখী। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ছত্রছায়ায় কেবল পুলিশই নয় তৎকালীন সরকার দলীয় ক্যাডাররাও তাদের যৌথ হামলা জোরদার করে। এসবের ধারাবাহিকতায় ১৯ জুলাই, শুক্রবার পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সেদিন এই নারী বীর নাঈমা সুলতানাকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। তিনি মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শাহাদাত বরণ করেন।
শহিদের মায়ের সাথে রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের প্রতিনিধির সাথে কথা হয়। উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে বাংলাদেশ মেডিকেলের ঠিক পেছনের মেইন রাস্তার ওপর নাঈমাদের ভাড়া বাসা। গোলাম মোস্তফা (৪৪) ও আইনুন নাহার (৩০) দম্পতির মেজ সন্তান ছিলেন তিনি। ছিলেন তিন ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী। এখনো বাসার ড্রইং রুম ও তার রুমে বিজ্ঞান বিভাগের বই ও গাইডগুলো থরে থরে সাজানো। পুরো ঘরের চারদিকে নাঈমার স্মৃতি। সবই আছে, শুধু নেই শহীদ নাঈমা সুলতানা।
তাঁর মা বাসসকে বলেন, ‘আমার মেয়েটা খুব মেধাবী ছিল। আমাদের বাড়ি চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর থানার আমুয়াকান্দি গ্রামে। সেখানে প্রথম শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত সবগুলো ক্লাসে সে প্রথম স্থান অর্জন করে। তারপর শুধুমাত্র ছেলেমেয়েদের ভালো লেখাপড়ার জন্য আমরা এই উত্তরায় এসে বাসা ভাড়া করে থাকতে শুরু করি। ওর বাবা গ্রামে একটা ফার্মেসি চালায়। সেই ফার্মেসীর আয় দিয়ে তিনটা ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া, কি যে কষ্ট, বলে বোঝাতে পারবো না। তারপরও ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যবসার জন্য ওর বাবা গ্রামে থাকে আর আমি বাচ্চাগুলোকে নিয়ে ঢাকায় একা থাকি। ও শুধু বলতো, মা আমি আন্দোলনে যাবো, আমি মিছিলে যাবো। আমার স্কুল থেকে মিছিলে গেলে আমি যাবো, তুমি আমাকে না করতে পারবা না। শুধু নিজেই মিছিলে যেত না, অন্যদেরকেও উৎসাহিত করতো। বন্ধুদেরকে বলতো, তোরাও মিছিলে আয়। সে চিত্র এঁকে এঁকে বন্ধুদেরকে নিয়ে আন্দোলনে শরিক হয়েছিল।
শহিদ নাঈমা সুলতানার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। স্বপ্ন পূরণে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় এসে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন উত্তরাস্থ মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে। মৃত্যুর সময় এই স্কুলের দশম শ্রেণি বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি খুব ভালো ছবি আঁকতেন। সে যোগ্যতা তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন এবারের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। উত্তরার অনেক দেয়ালে এখনো সে গ্রাফিতিগুলো জ্বলজ্বল করছে, যা এখন শুধুই স্মৃতি। এ শহিদের স্মৃতির প্রতি সম্মান রেখে উত্তরার ছাত্র-জনতা সোনারগাঁ জনপথের একদম পশ্চিম মাথা খালপাড়ের নামকরণ করেন ‘নাঈমা চত্বর’।
এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় শহিদ নাইমা সুলতানাদের ফ্ল্যাটের উপর তলার প্রতিবেশী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের সাথে। যিনি শহিদ নাঈমার নিথর দেহ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, সেদিন ছিল শুক্রবার। উত্তরার ছাত্র-জনতা এর আগের দিন অর্থাৎ ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবারের গণহত্যার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। উল্লেখ্য ১৮ই জুলাই উত্তরায় ৩০ জনের বেশি শাহাদাত বরণ করেন। শহিদদের সঠিক সংখ্যা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। কারণ সেদিন অনেকগুলো লাশ পুলিশ গুম করেছিল। সেদিন উত্তরার উপর দিয়ে যেন রোজ কেয়ামত নেমে এসেছিল। এ নারকীয় গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী উত্তরার ছাত্র-জনতা তাই পরদিন শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে তীব্র প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে। ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে ছাত্র-জনতা।
এ গণমাধ্যম কর্মী আরও বলেন, সেদিন সেই শুক্রবারের আন্দোলনের একটি বিশেষ দিক ছিল বেশিরভাগ ছাত্রদের সাথে তাদের অভিভাবকরা যোগ দিয়েছিলেন। অভিভাবকদের কথা ছিল, ‘গতকাল আমাদের সন্তানদেরকে কেন গুলি করা হলো? ছোট ছোট মাসুম বাচ্চা, এসএসসি/ এইচ এস সি পর্যায়ে পড়ে। ওরা তো কোন অন্যায় করেনি, অপরাধ করেনি। ওরা ওদের বৈধ অধিকারের কথাই শুধু বলেছে।ওদেরকে এভাবে গুলি করে মেরে ফেললে আমরা কাদের নিয়ে বাঁচবো। আমাদেরকেও মেরে ফেলেন।’
ওইদিন শুক্রবার দুপুর বারোটা থেকেই শিক্ষার্থীদের সাথে চলে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। শহিদ নাঈমা সুলতানা ও তার সহযোদ্ধারা বাংলাদেশ মেডিকেলের সামনের সোনারগাঁ জনপথে অবস্থান করছিলেন। একপর্যায়ে বিকেলের দিকে পুলিশ ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের ধাওয়ার মুখে টিকতে না পেরে বাংলাদেশ মেডিকেলের পেছনে তাদের বাসার সামনে চলে আসেন। আর পুলিশ অবস্থান নেয় বাংলাদেশ মেডিকেলের পাশের গলির মুখটাতে, একেবারে মুখোমুখি। এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি ছবি ও ভিডিও এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। আশপাশের বিল্ডিং থেকে সাধারণ মানুষ যেগুলো ধারণ করেছে, সেগুলোতে খুনিদের চেহারা একদম দৃশ্যমান।
শহিদ নাঈমা সুলতানা তখন তাদের বাসায় ওঠেন। বাসায় উঠে বারান্দা থেকে ২০০ গজ দূরে পুলিশের অবস্থান দেখার চেষ্টা করেন। ঠিক তখনই মুহুর্মুহু গুলিতে অসংখ্য শিক্ষার্থী লুটিয়ে পড়েন আর শহিদ নাঈমা সুলতানার ঠিক মাথার মধ্যে গুলি লাগে বেশ কয়েকটা। সাথে সাথেই তিনি বারান্দাতে লুটিয়ে পড়েন। বাসার লোকজন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। তখন তাদের ডাক-চিৎকারে আশপাশের ফ্ল্যাটের মানুষজন দৌড়ে আসেন। আশেপাশের বাসিন্দারা সব দেখতে পাচ্ছিলেন। অনেকেই তখন এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন, যা এখন এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য অনেক বড় একটা দলিল।
কথা হয় শহিদের বড় বোন তাসপিয়া সুলতানার সাথে। যিনি মাইলস্টোন কলেজের একাদশ শ্রেণী বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। দুই বোন ছিলেন পিঠাপিঠি।
তিনি বলেন, ‘আমরা দুইজন একসাথেই স্কুলে যেতাম এবং লেখাপড়া করতাম। এ বছর আমি এসএসসি পাস করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়াতে ওর সাথে আমার ক্লাসের সময়টা ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তারপরও আমাদের খুনসুটি লেগেই থাকতো। আজকে আমার একমাত্র আদরের ছোট বোনটি নেই। কাকে নিয়ে আমরা বেঁচে থাকব? আমাদের জীবনে এখন শুধুই শূন্যতা।’
একমাত্র ছোট ভাই আব্দুর রহমান। সেও পড়ে একই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীতে। সে আমাদের সাথে কোন কথাই বললো না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো।
মামলার বিষয়ে শহিদের মাকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় আমাদের পরিবারের অভিভাবক নেই বললেই চলে। কে মামলা করবে, কে মামলা চালাবে? এ জন্য আমরা মামলা করিনি। আমরা আল্লাহর দরবারে মামলা করেছি, তিনি এর বিচার করবেন। ওর বাবা গ্রামে থাকে এবং অসুস্থ। আদরের মেয়েকে হারিয়ে সে আরো অসুস্থ হয়ে গেছে। ঢাকায় এসে থাকতেই পারে না। ওর জিনিসপত্র দেখলে ডুকরে কেঁদে ওঠে। তাই আমিও আর তাকে ঢাকায় থাকার জন্য চাপ দেই না। একটা সন্তানকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কত কষ্ট করে আমরা বড় করেছি। সেই সন্তানের লাশ মায়ের সামনে। সন্তানের লাশ বাবার কাছে কত যে কঠিন, তা তো বলে বোঝাতে পারবো না। গত আড়াই মাস যাবত ভালো কিছু রান্না করতে পারি না, ভালো কিছু খেতে পারি না। খেতে গেলেই শুধু মেয়েটার কথা মনে হয়। আমরা এখন গ্রামে চলে যাবো, আর ঢাকায় থাকবো না। যে শহর আমার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে, সে শহরে আমি থাকবো না।’
সরকারি কিংবা বেসরকারি কোন অনুদানের কথা বললে তিনি বলেন, আমরা শুধু জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে দুই লক্ষ টাকা পেয়েছি। সরকার কিংবা আর কারো কাছ থেকে কোন সহযোগিতা আমরা এখনও পর্যন্ত পাইনি।
এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় আশপাশের প্রতিবেশী এবং নাঈমার সহপাঠীদের সাথে। সবার একটিই কথা, উত্তরায় প্রায় শতাধিক শহিদ হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হতেই হবে স্বাধীন বাংলাদেশে। আমরা যদি এসব হত্যার বিচার করতে না পারি, তাহলে শহীদদের কাছে যে আমরা অনেক ছোট হয়ে যাবো। তাদের পরিবারের কাছেই বা কি জবাব দেবো?