শিরোনাম
সুনামগঞ্জ, ২৯ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস) : গ্রামের বাড়িতে ছোট্ট ডোবার পাড়ে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন শহিদ সোহাগ মিয়া। তাঁর কবরের পাশেই উড়ছে লাল সবুজের জাতীয় পতাকা। ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে হাত তুলে মোনাজাতে কাঁদছেন বাবা মো. আবুল কালাম। দুই চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় ঝরতে থাকা পানিতে বুক ভেসে যাচ্ছে তাঁর। এমন মর্মস্পর্শী দৃশ্য চোখে পড়ে জামালগঞ্জ উপজেলার গুলামিপুর গ্রামে গিয়ে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিজয় মিছিলে শরীক হওয়া শহিদ সোহাগ মিয়া’র বাবার কান্না কিছুতেই থামছে না জানালেন গ্রামবাসী।
স্বৈরাচারী সরকারের পতনের খবরে গত ৫ আগস্ট প্রতিটি পাড়া মহল্লায় বের হয় বিজয় মিছিল। দেশজুড়ে সেই মিছিলে শরীক হন কোটি জনতা। বিজয়ের সেই সন্ধিক্ষণে ঢাকার রাজপথের মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালী ইউনিয়নের গুলামিপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. সোহাগ মিয়া (২৩) ও শুভ মিয়া (২২) নামের দুই সহোদর। কে জানতো সেটাই হবে দুই ভাইয়ের একসঙ্গে শেষ বিজয় উল্লাস। মিছিলে গুলি চালায় নির্দয় পুলিশ, গুলিবিদ্ধ হন দুইভাই। গুলিতে জীবন প্রদীপ নিভে যায় বড় ভাইয়ের।
রাজধানীর বাড্ডা এলাকার মিছিলে যুক্ত হয়েছিলেন তারা। মিছিলটি বাড্ডা থানার সামনে আসলে পুলিশ গুলি চালায়। সেই মিছিলে দুই ভাই গুলিবিদ্ধ হলে প্রাণ যায় বড় ভাই সোহাগ মিয়ার। পর দিন মঙ্গলবার ৬ আগস্ট বেলা ২ টায় জামালগঞ্জ উপজেলার হেলিপ্যাড মাঠে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতাকর্মী ও সমর্থকবৃন্দসহ হাজারো ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে নিহতের নামাজে জানাযা সম্পন্ন হয়। এরপর তাঁর গ্রামের বাড়ির পঞ্চায়েতি কবর স্থানে শহিদ সোহাগের দাফন করা হয়।
ছয় ছেলেমেয়ের পিতা দিনমজুর আবুল কালাম। অসহায় এই পিতা রিকশা চালাতেন জামালগঞ্জ উপজেলা সদরে। পরে বার্ধক্যে উপনীত হলে রিকশা ছেড়ে জমি বর্গা চাষ শুরু করেন। জমি চাষের ফাঁকে দিনমজুরি করছেন। কখনও বেকার থাকতেন না তিনি। মা রোকেয়া বেগম ছেলেদের সাথে ঢাকায় থাকতেন। তিনি চাঁদপুরের মেয়ে। অভাবের কারণে সন্তানরা পড়াশোনা করতে পারেনি। সন্তানদের মধ্যে সোহাগ তৃতীয়। ২০০১ সালের ৭ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালি ইউনিয়নের গোলামীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। গোলামীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন সোহাগ।
মা-বাবার পরিবারে ৫ ভাই ও ১ বোন তারা। এর মধ্যে শহিদ সোহাগ ছিলেন ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয় ও পরিবারের তৃতীয় সন্তান।
এদিকে তৃতীয় ভাই শুভ গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হয়ে গেছেন। বড় ভাই বিল্লাল মিয়া, চতুর্থ ভাই যুবায়ের মিয়া ও পঞ্চম ভাই আজিম মিয়া এই তিন ভাই রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। শুভ বিয়ে করেন ঢাকায়। তার একমাত্র কন্যা নুসরাত আক্তার সোহাগীর বয়স ১ মাস ২০ দিন। বড় বোন আফিয়া বেগমের বিয়ে হয় রংপুরে। তার স্বামী আনসার বাহিনীতে চাকরি করেন।
করোনা মহামারির সময়কালে বিদেশ যাওয়ার উদ্দেশ্যে গ্রামের বাড়ি হতে বের হন সোহাগ। কিন্তু প্রতারক দালালের খপ্পরে পড়ে আর বিদেশ যাওয়া হয়নি তার। খবর পান দালাল ব্যাটা সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করছেন। পাওনা টাকা উদ্ধারের লক্ষ্যে তিনিও চলে যান পাথারিয়া গ্রামে। সেখানে পাথারিয়া নিবাসী সুন্দর মিয়ার বাড়িতে দেড় বছর অবস্থান করে একাধারে পাওনা টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করেন অন্যদিকে পাথারিয়া সেতুর নির্মাণ কাজে শ্রমিক মজুরের দায়িত্ব পালন করেন। সোহাগের পিতা ২০১৯ সালে সোহাগকে প্রবাসে পাঠাতে ঋণ ও জায়গা জমি বিক্রি করে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলেন দালালের হাতে। কিন্তু দালাল কর্তৃক প্রতারিত হন আবুল কালাম। এই ঋণের টাকাই তারা এখনও শোধ করতে পারেননি।
ঋণের টাকার জন্য এলাকা ছাড়েন একসঙ্গে পাঁচ ভাই। রাজধানীর বাড্ডা এলাকার হোসেন মার্কেট বউ বাজারে পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে একটি টিনশেড বিল্ডিং-এ থাকতেন তারা। তিন ভাই নিয়মিত রাজমিস্ত্রীর কাজ করতেন।
অন্যদিকে সোহাগ, হোসেন মার্কেটের আশা ফ্যাক্টরিতে দেড় বছর কাজ করেন। সেখানে তাঁর মাসিক বেতন ছিল ৯ হাজার টাকা। কিন্তু ফ্যাক্টরিতে অভারটাইম কাজ করে আরো ৫ হাজার টাকা রোজগার করতেন সোহাগ।
গত পাঁচ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিল দেখে টগবগে এই তরুণরা নিজেদের আটকাতে পারেননি। যোগ দেন মিছিলে। মিছিলটি বাড্ডা থানার সামনে আসলেই পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। এখানেই গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন সোহাগ। শুভ’র শরীরেও গুলি লাগে। তিনি এখন পঙ্গু।
শুভ বলেন, ‘সবার সঙ্গে আমরাও মিছিলে যোগ দেই। মিছিলটি বাড্ডা থানার সামনে গেলে পুলিশ গুলি করে। সেখানে আমার শরীরেও গুলি লাগে। পরে অন্যরা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমার ভাইয়ের শরীরেও গুলি লাগে। সে ওখানেই মারা যায়। তিনি বলেন, হাসপাতালে সার্মথ্য অনুযায়ী চিকিৎসা করিয়ে বাড়িতে চলে আসি। এখনও পায়ে দু’টি গুলি রয়ে গেছে। আগের মতো কাজ করতে পারি না। পা ব্যথা করে। টাকা পয়সার অভাবে অপারেশন করে গুলি বের করতে পারছি না।’
শুভ মিয়া’র পায়ে এখনো ছররা গুলি আটকে আছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না বলে জানালেন পরিবারের সদস্যরা।
শহিদ সোহাগের বড় ভাই মো. বিল্লাল মিয়া বলেন, ২০১৯ সালে ভাইকে বিদেশ পাঠানোর জন্য জায়গা জমি, গরু বিক্রি করেছি তবুও টাকা মেলাতে না পারায় মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দিয়েছি। সেই দালাল আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এক টাকাও ফেরত পাইনি। পরে ঋণের চাপে আমরা পাঁচ ভাই এলাকা ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে কাজ শুরু করি।
ছেলে হারানোর শোকে কাতর মা রোকেয়া বেগম বললেন, ‘আমার ছেলে ঘরে এসে আমার মন খারাপ দেখলে জড়িয়ে ধরতো। মন ভালো করে দিতো সে। আজ সে নেই।’ ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন তিনি।
সোহাগের বাবা আবুল কালাম বলেন, হার্টে সমস্যার কারণে চার বছর ধরে কাজ করতে পারি না। ঢাকা থেকে ছেলেরা কাজ করে টাকা পাঠায়। সে টাকায় সংসার চলে। ছেলে মারা যাওয়ার পর সবাই বাড়িতে এসেছিল, এখনো আছে। ধার-দেনা করে সংসার চলছে বলে জানান তিনি।
এক শতক জায়গায় একটি ভাঙাচোরা ঘরে বসবাস শহিদ সোহাগের পরিবারের। জং ধরা টিন, বাঁশের এই ঘরটির চালা ফুটো। বৃষ্টি হলে ঘরে থাকা দায়। প্রতিবেশীদের দাবি, গুলিবিদ্ধ ছেলে শুভ মিয়ার উন্নত চিকিৎসা ও পরিবারের জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই করবে সরকার।
জামালগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ বলেন, পাঁচ ছেলের মধ্যে দুই ছেলেই ছাত্র জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। সেখানে এক ছেলে মারা গেছে, আরেকজন আহত অবস্থায় আছে। তার পায়ে এখনও গুলি রয়ে গেছে। আমরা চাই গুলিবিদ্ধ ছেলের উন্নত চিকিৎসা সরকার করবে। এছাড়াও তার পরিবারের জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা করার দাবি জানাই সরকারের কাছে।
অপর এক খবরে জানা যায়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ঢাকায় নিহত শ্রমিক সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার গোলামীপুর গ্রামের শহিদ সোহাগ মিয়ার পরিবারকে আর্থিক অনুদান প্রদান করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এছাড়া জামালগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের গোলামীপুর গ্রামে নিহত সোহাগ মিয়ার পরিবারের খোঁজ-খবর নিতে আসেন বাংলাদেশ জমায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলার নেতৃবৃন্দ।
বক্তারা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত সকলকেই বীর যোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, আগস্ট মাসের ৫ তারিখে আল্লাহর পক্ষ থেকে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে এদেশের ছাত্র-জনতার ঐক্যে জুলুমবাজ আওয়ামী লীগের সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। পরে নিহতের পরিবারের হাতে দুই লাখ টাকার আর্থিক অনুদান তুলে দেন নেতৃবৃন্দ।