বাসস
  ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৪:২৮

‘সর্বস্ব দেবো, বিনিময়ে ছেলেকে ফিরিয়ে দিন’ এ আর্তনাদ শহিদ শাওনের পিতা বাছিরের

॥ সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন ॥
ঢাকা, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস) : পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মেধাবী শাহাদাত হোসেন শাওন দিনমজুর বাবার পরিবারে যেন আশার আলো হয়েই জন্মেছিলেন। ছেলেকে নিয়ে ষাটোর্ধ্ব বাছির ও তার পরিবারের স্বপ্নও ছিলো অনেক বড়।
শাওনের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের সেবায় আত্মনিয়োগের পাশাপাশি পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত তিনি পেলেন না।  মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে তার স্বপ্নের অকাল মৃত্যু ঘটে।
স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার পতনের পর নগরীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় হাজারো উৎফুল্ল মানুষের সাথে আনন্দ মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন শাওন। কিন্তু ফিরলেন লাশ হয়ে ।  
শহিদ শাহাদাত হোসেন শাওন ঢাকার পশ্চিম ধোলাইপাড় এলাকার বাসিন্দা মো: বাছির আলম ও শামছুন নাহার বেগমের  কনিষ্ঠ পুত্র। তিনি নূরে মদিনা আল আরাবিয়া মাদ্রাসার দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।  তিনি  কোরানে হাফেজ হওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে নাজেরা ক্লাসে পড়তেন।
বাছির আলম বাসসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘আমার ছেলে শাওন পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। আমার পাঁচ সন্তান। চার ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে শুধু শাওনই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল’।
ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত পিতা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘শাওনের  বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন ছিল। আমরা আশা করেছিলাম যে তার মাধ্যমে আমাদের ভাগ্য পাল্টে যাবে।’   
শাওন ছিলেন তার বাবার হাতের লাঠি। কুতুবখালী এলাকায় যাত্রাবাড়ী বড় মাদ্রাসার সামনে হালিম বিক্রির কাজে বাবাকে সাহায্য করতেন শাওন। তিনি তার বাবাকে হজে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলতেন। যা বাছিরের মতো নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য দিবাস্বপ্নের মতো।
‘আব্বু তুমি এখন রোদ-বৃষ্টির নিচে কঠোর পরিশ্রম করছো। কতো কষ্ট করছো। তুমি জীবনে একদিন সুখ নেমে আসবে। খুব সুখের জীবন হবে তোমার। আমি তোমাকে বিমানে করে  হজে যাওয়ার ব্যবস্থা করবো’- শাওনের এসব কথা এখন হতভাগ্য পিতা বাছিরের কাছে কেবলই স্মৃতি। এসব স্মৃতিই এখন তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দেয়।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজলা ও শনির আখড়াসহ যাত্রাবাড়ী এলাকায় গত ১৭ জুলাই থেকে সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমে আসে। তারা বিক্ষোভে যোগ দেয়। পুলিশের বাধা ও হামলায় এ সময় এলাকাটি উত্তপ্ত এক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
তবু সময়ের দাবি এমন ছিল যে শতো বাধাতেও মানুষের পক্ষে আর ঘরে বসে থাকা সম্ভব হয়নি। মানুষ অকাতরে নেমে এসেছে রাস্তায়। প্রাণ দিয়েছে হাসি মুখে।
এমনকি একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, একজন নারীকে তার ছয় থেকে সাত মাস বয়সী শিশুকে কোলে নিয়েও রাস্তায় শ্লোগান দিতে দেখা গেছে।  
শাওনের পরিবারও বসে ছিল না। তার বাবাসহ বড় তিন ভাই  মোঃ হানিফ, মোঃ সাদ্দাম ও মোঃ ইয়াসিনসহ পরিবারের সকলেই ধোলাইপাড়, কাজলা ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ২০ জুলাই কারফিউ জারি করে সরকার যখন দৃশ্যত শহরের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হয়, সে সময় থেকে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী এলাকার পুরোটা বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল।
শাওনের উদ্বৃতি দিয়ে তার বাবা বলেন ‘শেখ হাসিনা আমাদের রাজাকারের সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমরা দেশের জন্য আমাদের জীবন উৎসর্গ করব, এটা প্রমাণ করার জন্য যে আমরা রাজাকারের সন্তান নই।’
ক্ষমতাচ্যুত  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের বাচ্চা’ মন্তব্য শাওনকে গভীরভাবে আহত করেছিল এবং তাকে রাস্তায় বিক্ষোভে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র মো: হামিম বাসসকে বলেন, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের খবর শুনে যাত্রাবাড়ী এলাকায় হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নামেন। তিনি বলেন,  ‘আমি এবং আমার চাচাতো ভাই হাজার হাজার লোক নিয়ে ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে ধোলাইপাড় থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রাবাড়ী গিয়েছিলাম। আমরা যখন যাত্রাবাড়ী পৌঁছালাম, তখন দেখি যাত্রাবাড়ী থানা ভবনের ছাদ থেকে দুই পুলিশ সদস্য এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ছে।’
গত ১৭ জুলাই থেকে রাস্তায় বিক্ষোভে থাকা মো. হামিম বলেন,‘পরিস্থিতি এতটাই খারাপের দিকে গিয়েছিলো যে, এক পর্যায়ে তার চাচাতো ভাই তাকে ঘটনাস্থল ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।’
তিনি বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে আমরা যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করার চেষ্টা করছিলাম, তখন দেখি শাওন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ফ্লাইওভারের ওপর পড়ে আছে। একজন পুলিশ সদস্য শাওনকে লক্ষ্য করে পরপর তিনটি গুলি করে। প্রথমটির লক্ষ্য ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয়টি হাতে এবং তৃতীয়টি তার মাথায় বিদ্ধ হয়।’
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, শাওনের হাতে ও মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপর হামিমই প্রথম ব্যক্তি যিনি শাওনকে উদ্ধার করতে এগিয়ে যান। কিন্তু এলোপাতাড়ি গুলি চালানোর কারণে তিনি কিছুই করতে পারছিলেন না।
পরে অন্যদের সহায়তায় হামিম শাওনকে উদ্ধার করে দয়াগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শাওনের বাবা বাছির এবং মা শামছুন নাহার তাদের সবচেয়ে আদরের ছেলেকে হারিয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। কারণ তারা বিশ্বাস করেছিলেন, আল্লাহ তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই শাওনকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তারা আজ ভাগ্য বিড়ম্বিত। অসহায়। কান্নাই আজ তাদের একমাত্র সম্বল।
‘আমার কোনো টাকার দরকার নেই। বরং আমি আরও টাকা দেবো এবং আমার যা কিছু আছে তাও দেব। তবু দয়া করে আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন।  আমি আর কিছুই চাই না। কেবল ছেলেকে চাই। আমার শাওন আমাকে আবার বাবা ডাকলে আমার হৃদয় জুড়িয়ে যাবে। আমি শান্তি পাবো’। কাঁদতে কাঁদতে বাছির প্রতিবেদককে এ কথাগুলোই বলছিলেন বারবার।
বাছিরকে সাথে নিয়ে এ প্রতিবেদক যখন রিকশা করে পশ্চিম ধোলাইপাড়ে শাওনদের বাড়িতে যাচ্ছিলেন তখন পুরো রাস্তা জুড়েই তিনি কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, আমাকে অনেকেই বলছেন, ‘অনেক টাকা পাবেন’। আমি তাদের বললাম, ‘এই টাকা দিয়ে আমি কি করব? আপনরা টাকা ফিরিয়ে নেন, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেন। আমি আরো টাকা দেবো, তবু আপনারা আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনুন।
তিনি আহাজারি করে বলেন, ‘এখন কে আমাকে বাবা ডাকবে? কে আমার হৃদয়কে শান্ত করবে?’
ছেলের স্মৃতিচারণ করতে করতে স্বগোতক্তি করেন বাছির, ‘আমার সোনার থালা হারিয়ে গেছে! এখন আমাকে মসজিদে যেতে কে বলবে? আর কে আমার যতœ নেবে?’
গত আড়াই মাস ধরে শাওনের স্মৃতি তাকে ক্রমাগত তাড়া করে ফিরছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শাওন আমার সঙ্গেই ঘুমাতো। গত ৫ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠে মেঝে থেকে খাটে যেতে বলি। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো, কিন্তু কোন কথাই বললো না। এটা ছিল তার সাথে আমার শেষ আলাপ। সেই দৃশ্য আমি এক মূহুর্তের জন্যও ভুলতে পারি না।’
হতভাগ্য পিতা বাছির তার চারপাশের বাতাসেও যেন আদরের সন্তানের কণ্ঠ শুনতে পান। তিনি বলেন, ‘ছেলেকে হারিয়ে আমি আজও দিশেহারা। আমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছি। কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখের আলোও কমে আসছে। আমি কম দেখতে পাচ্ছি।’
এদিকে শাওনের মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ওই দিন দুপুর ২টা পর্যন্ত শাওন আমার সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল। সেদিন, আমি গুলগুইলা (এক ধরনের স্থানীয় পিঠা) তৈরি করেছিলাম। এটা ছিল আমার হাতে তার শেষ খাবার। গুলগুইলা খেতে খেতে শাওন বলেছিলো পিঠাটা অনেক মজা হয়েছে এবং বলতে বলতে আরো একটু খেয়েছিলো’।
শামছুন নাহার বলেন, শেখ হাসিনার পালানোর খবর শুনে শাওন যখন বাইরে যাচ্ছিল তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাচ্ছো’? কিন্তু সে আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি, বরং পেছনের দিক থেকে তার হাত দিয়ে আমাকে বিদায়ের চিহ্ন দেখাল। কারণ, সে আশংকা করছিল যে সে যদি পিছনে ফিরে তাকায় আমি তাকে বাধা দেবো।
তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, মৃত্যুর দিন শাওন কালো পোশাকে বাইরে গিয়েছিলো।
তিনি জানান, এর আগের দিন ৪ আগস্ট তার ছেলে কুতুবখালী এলাকায় রাস্তায় নেমে অল্পের জন্য গুলি থেকে রক্ষা পায়।
শামছুন নাহার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘তার মৃত্যুতে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। আমার মনে হয় আমার ছেলেটা এখনও মারা যায়নি। সে হয়তো কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে গেছে। সে শিগগিরই ফিরে আসবে এবং একইভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে।’
শাওনের বড় ভাই মোঃ হানিফ ফুটপাতে দোকান চালান। তিনি জানান, ওই দিন সকাল ৮টায় তিনি ধোলাইপাড়ে আন্দোলনে যোগ দিতে গেলে দেখেন পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমি আহত একজনকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার সময় আমাদের সামনে অন্তত ২৫-২৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমি যাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
তিনি শোকার্ত কন্ঠে বলেন, ‘কিন্তু ঢাকা মেডিকেল থেকে ফিরে এসে শুনলাম আমার ভাইই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে।’
ওইদিন হানিফ নিজেও রাবার বুলেটে আহত হন। সেই অবস্থায়ই তিনি ভাইয়ের লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যান। ছোট ভাইকে দাফন করার পর তিনি স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিজের চিকিৎসা নেন।
নুরে মদিনা আল আরাবিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শাওনের শিক্ষক মুফতি এবিএম শরীফ উল্লাহ বলেন, শাওনের মুখ ছিল হাসিখুশি। তার আচরণ খুবই ভালো ছিল। সে কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি।
তিনি বলেন, ‘যখনই আমি তাকে কোনো কাজ দিতাম, সে সঙ্গে সঙ্গে তা করে দিত। সে ছিল মায়াবী। ২০২১ সালে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার যখন আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল, তখন সে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলো। যেহেতু তার বাবা খুবই দরিদ্র, তাই তার শিক্ষার খরচ আমিই বহন করতাম।’
কারো কাছ থেকে কোন অনুদান পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে শাওনের বাবা বাছির জানান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী  এক লাখ টাকা দিয়েছে। এছাড়া সরকার বা অন্য কোনো সংগঠন তাদের কোন খোঁজ খবর নেয়নি।
আর্থিক সংকটের কারণে ডাক্তারের কাছে যেতে পারছেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার স্ত্রীও খুব অসুস্থ। শাওন আমাদের ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে সেও ঘুমাতে পারে না। সে বুকের ব্যাথায় ভুগছে।
তিনি বলেন, তাদের প্রতিদিন চার থেকে পাঁচশ টাকার ওষুধ লাগে। ব্যথার জন্য মাসে যে একটি ট্যাবলেট লাগে তার দাম ১,২০০ টাকা।
তিনি বলেন, ‘আমাদের তেমন কোন চাওয়া নেই। কেবল চাই  আমার ছেলের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার হোক।’