বাসস
  ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২০
আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৮:৩০

সঠিক চিকিৎসাটুকুও ভাগ্যে জুটেনি শহিদ জাবেদের

॥ মো. সাজ্জাদ হোসেন ॥
ঢাকা, ২ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : মায়ের পাঁজরের ব্যথাটা কিছুদিন ধরে অনেকটাই বেড়েছে। অসহ্য ব্যথায় ঘুমাতে পারেন না তিনি। চলাফেরা করতেও কষ্ট হচ্ছে। অনেকদিন আগে থেকেই এই ব্যথায় ভুগছেন তিনি। ডাক্তার বলেছিলেন একটা অপারেশন করাতে হবে। আমার ভাই জাবেদ চেয়েছিল যেভাবেই হোক মাকে অপারেশনটা করাতে। একদিকে অভাবের সংসার অন্যদিকে মায়ের ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ায় অপারেশনটা তখন করানো যায়নি। এরমধ্যেই আমাদের পরিবারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। যে ভাইটি মাকে অপারেশন করাতে চেয়েছিল, সেই ভাইটিই জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।

কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন শহিদ মোহাম্মদ জাবেদের (২৬) বড় ভাই ইলেকট্রিক মিস্ত্রি মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন (৩৪)।  মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যান পুলিশ ফাঁড়ির কাছে এক রুমের একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি। স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে, ছোট ভাই ও মাকে নিয়ে তাদের সংসার। বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সম্প্রতি তিনি রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন। বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘একটি মাত্র রুম ভাড়া করে থাকি, তাই আপনাকে বাসায় যাওয়ার কথা বলতে পারছি না। আগে আমরা তিন ভাই ও মাসহ মোহাম্মদপুর নবীনগর হাউজিংয়ে ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া করে থাকতাম। ভাই জাবেদ চলে যাওয়ার কারণে পরিবারের আয় কমে গেছে, তাই এখন ছোট্ট একটা রুম নিয়ে কোনভাবে টিকে আছি।’

ছোট ভাই জাবেদ শহিদ হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জাবেদ মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ে ভ্যানে করে ফল বিক্রি করতো। মাঝে মাঝে ওই ভ্যানে করেই শাক-সবজিসহ যখন যা পারতো তাই বেচে সংসার চালাতো। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে যেদিন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন সেই ৫ আগস্ট সে বাসা থেকে বের হয়। ওইদিন আমি বাসায় ছিলাম না। বান্দরবানে কাজে গিয়েছিলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা অবদি বাসায় ফিরে না আসায় মা নানা দিকে খোঁজ করতে শুরু করেন। কিন্তু কোন সন্ধান না পেয়ে আমাকে ফোন দেয়। জানায় যে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি মাকে আশ^স্ত করে বলি, চলে আসবে। চিন্তা করো না। হয়তো কোথাও গেছে। পরদিন ৬ আগস্টও বাসায় আসেনি। মা আমাকে এই কথা জানালে আমি রাতেই রওয়ানা দিয়ে ৭ আগস্ট সকাল ৯টার মধ্যে ঢাকায় চলে আসি। যেহেতু কোথাও কোন খোঁজ পাচ্ছি না, চতুর্দিকে অনেক মানুষ মারা গেছে, আমরা মনে করেছি হয়তো কোথাও গুলি লেগে মারা গেছে। অথবা কোন হাসপাতালে আছে। তাই ওইদিন সারাদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গসহ বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করি। কিন্তু কোন সন্ধান পাইনি। এদিকে মা ভাইয়ের জন্য ভীষণ কান্নাকাটি করছেন। বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। আমরা একেবারে দিশেহারা হয়ে যাই।’

তিনি বলেন, রাত পৌনে ১২টার দিকে আমার মোবাইলে একটা ফোন আসে। মিরপুর ১৪ নম্বর সরকারি ডেন্টাল হাসপাতালের এক নার্স ফোন করে জানায়, ‘আপনার ভাই জাবেদ এই হাসপাতালে আছে, সে গুলি খেয়েছে।’ ওইদিন রাতেই একটা সিএনজি করে আমি আর মা হাসপাতালে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি আমার ভাই অবশ হয়ে পড়ে আছে। কাছে যেতে চাইলে পুলিশ আমাদের কাছে যেতে দেয়নি। পরদিন সকালে আমাদের যেতে বলে। এরপর আমরা বাসায় চলে আসি।

সকালে গিয়ে দেখি তার মুখে অপারেশন করা, মাথাসহ ব্যান্ডেজ করে রাখা হয়েছে। বাম কানের নিচ দিয়ে গুলি ঢুকে মুখের চোয়াল ভেঙ্গে থুতনির দিকে চামড়ার নিচে আটকে ছিল, ডাক্তার অপারেশন করে গুলিটা বের করেছে। আমরা জাবেদের সাথে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু সে কথা বলতে পারছে না। ইশারায় আমাদের জানায়, গুলি লেগে পড়ে যাওয়ার পর পুলিশ রাইফেলের বাট দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে। এতে মস্তিস্কেও আঘাত লেগেছে বলে পুলিশ আমাদের জানায়। তার কান দিয়ে অনবরত রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিল। কোনভাবেই রক্ত বন্ধ করা যায়নি- বলেন মাইনুদ্দিন।  

ডেন্টাল হাসপাতালের ডাক্তারের পরামর্শে আমরা জাবেদকে নিয়ে আগারগাঁও নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চলে আসি। সেখানে ডাক্তার একটা এমআরআই করে দেখেন কানের উপরে মাথার বাম পাশে অনকটা জুড়ে রক্ত জমে আছে। আমাদের রোগী নিয়ে ঢাকা মেডিকিল কলেজ হাসপাতালে চলে যেতে বলেন। আমরা অনেক অনুরোধ করি এখানে রাখার জন্য। এমনকি একটা পাটি বিছিয়ে হলেও ওইখানে থাকতে চাই, কারণ ঢাকা মেডিকেলে এতো রোগীর মধ্যে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া যাবে না। কিন্তু কোন ভাবেই সেখানে না রাখায় উপায়ান্তর না দেখে ঢাকা মেডিকেলে চলে আসি, বলেন মাইনুদ্দিন।

তিনি বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলে এসেও কোনভাবেই ভর্তি করাতে পারছি না। ৩ ঘন্টা পর একজন ছাত্র ভাইকে ধরে জাবেদকে সেখানে ভর্তি করাই। সেখানেও অনেক আহত রোগী আর মানুষ। এতো রোগীর ভীড়ে সেখানে সিট না পেয়ে একটা মাদুর পেতে তাকে নিয়ে আমি থাকি। কিন্তু ডাক্তাররা দিনে একবার এসে কোন রকম দূর থেকে দেখে যেতো। সে যে একটা গুলি খাওয়া রোগী, তার ওপর মস্তিস্কে আঘাত। একটু যে বিশেষ যত্ন নিয়ে দেখবে তা করেনি। এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় ১৩ তারিখ ভোর ৫টার দিকে আমার ভাই আমাদের ছেড়ে চলে যায়।’

শহিদ জাবেদের চিকিৎসায় ডাক্তারদের অবহেলার অভিযোগ করে তিনি অনেকটা আক্ষেপ ও ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘ডাক্তারদের অবহেলা আর অযত্নে আমার ভাই মারা গেছেন। যদি সঠিক চিকিৎসা করানো যেত হয়তো আমার ভাই বেঁচে যেত। কিন্তু কোথাও কোন চিকিৎসা পাইনি। আমরা প্রাইভেট হাসপাতালেও চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেউ রাখতে চায়নি। সেদিন নিউরোসেন্স হাসপাতালে রাখলেও সে মারা যেত না। সেখানে কম লোক ছিল, সঠিক চিকিৎসাটা অন্তত হতো। কিন্তু এরা ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়েছে। এখানেও নিউরোসায়েন্স বিভাগেই ভর্তি করেছে। তাহলে সেখানে রাখতে অসুবিধাটা কি ছিল?’

গত ১৩ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে জাবেদের লাশ নিয়ে এসে রাত ৯টার দিকে মোহাম্মদপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয় বলে তিনি জানান।

মাঈনুদ্দিন জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার খরকি গ্রামে। পিতা মৃত. আব্দুস সোবহান ও মা নুরজাহান বেগম (৫৫) এর ৫ ছেলে সন্তানের মধ্যে শহিদ মোহাম্মদ জাবেদ চতুর্থ। বড় দুই ভাই মোহাম্মদ ফারুক (৩৮) ও মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর (৩৬) বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন।

ছোট ভাই মোহাম্মদ সাজ্জাদ (১৮) এবার মোহাম্মদপুর গভর্ণমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছে। অর্থের অভাবে এখনো কোথাও ভর্তি হতে পারছে না। হয়তো এখানেই তার পড়াশোনা শেষ হয়ে যাবে। কারণ তার পড়াশোনার খরচও চালাতো জাবেদ। আমি টুকটাক ইলেক্ট্রিকের কাজ করি। আমার পক্ষেও এখন সংসার চালিয়ে মা-ভাইয়ের মুখে খাবার তুলে দেয়ার পর ছোট ভাইয়ের পড়ার খরচ চালানো কঠিন হবে। কারণ জাবেদের চিকিৎসা, দাফন-কাফনসহ আনুসঙ্গিক খরচ বহন করতে ৭০ হাজার টাকা মাসিক সুদে ঋণ করতে হয়েছে, কোন সংস্থা বা সরকারিভাবে এখনো কোন সহযোগিতাও পাইনি, বলেন মাইনুদ্দিন।

তিনি বলেন, অনেক বছর আগে মা বৃষ্টির দিনে পিছলে পড়ে কোমরে ব্যাথা পান। এ ছাড়া পাঁজরের হাড় ক্ষয় হয়ে যাওয়ায় চলাফেরা করতে পারেন না। জাবেদ মাকে ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার অপারেশনের পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু মায়ের ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়া  আর আর্থিক সমস্যার কারণে তখন অপারেশন করানো যায়নি। জাবেদ চলে যাওয়ার পর আর্থিক অনটনের কারণে ফ্ল্যাট বাড়ি ছেড়ে এক রুমের একটা বাসা নিয়ে থাকি। মা গ্রামে চলে গেছেন।

সেখানেও আমাদের নিজেদের কোন ঘর নেই, আমার খালার বাসায় থাকেন। ইচ্ছা ছিল গ্রামে একটা ঘর তুলবো। জাবেদকে বিয়ে করাবো। কিন্তু সব আশা এখন দূরাশায় পরিণত হয়েছে। মায়ের চিকিৎসা, ভাইয়ের পড়াশোনা সব মিলিয়ে আমরা এখন চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। জাবেদ বলতো, ‘নিজে অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে পারিনি, ছোট ভাইকে পড়াশোনা করে বড় করতে চাই। এজন্য যত কষ্ট করতে হয় আমরা করবো।’  

জাবেদের মা নুরজাহান বেগমের (৫০) সাথে ফোনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি ফোনের মধ্যেই হাউমাউ করে চিৎকার করে শুধু বলেন, ‘আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।’  

জাবেদ খুবই ভালো ছেলে ছিল, অনেকদিন ধরে সে এই চৌরাস্তায় আমাদের সাথেই ব্যবসা করতো। কোনদিন কারো সাথে বেয়াদবি করেনি। অত্যন্ত সাদাসিধে ও সচেতন ছেলে ছিল। কোন ধরনের লোভ লালসা ছিল না তার মধ্যে, বলেন ভ্রাম্যমান শাক বিক্রেতা মাসুদ আলী।  

তিনি বলেন, আমাকে সে বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করতো। কিন্তু কিভাবে যে কি হলো! আমরা চাই তার হত্যাকারীর বিচার হোক।

মাইনুদ্দিন জানান, ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় শাহবাগ থানায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মোহাম্মদপুর এলাকার কমিশনার, সংসদ সদস্যসহ ৫ জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এ মামলায় তার ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার হবে বলে তিনি আশা করছেন।