শিরোনাম
॥ বেলাল রিজভী ॥
মাদারীপুর, ৮ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : প্রায় আট বছর আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কাঁধে আঘাত পান শাহ আলম হাওলাদার। এরপর থেকে ভারি কোন কাজ করতে পারেন না। পরে আবার হার্টেও সমস্যা দেখা দেয়। এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে সংসারে তৈরি হয় আর্থিক টানাপোড়েন। হাল ধরতে বাধ্য হন স্ত্রী নাছিমা বেগম।
সেলাই এর কাজ করে কোনমতে চলতে থাকে সংসার। একমাত্র পুত্র সন্তান হৃদয় আহমেদ শিহাব যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো তখনই সংসারের হাল ধরতে ঢাকায় একটি ফার্ণিচারের দোকানে কাজে পাঠিয়ে দেন দরিদ্র এই দম্পতি।
ফার্ণিচারের দোকানে প্রায় তিন বছর ধরে কাজ করতো শিহাব। বেতন যা পেতো নিজের খরচ রেখে বাড়িতে পাঠিয়ে দিত সব টাকা। সংসারের হাল ধরা হৃদয় আহমেদ শিহাব(১৮) গত ১৯ জুলাই দুপুরে ঢাকার বাড্ডায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সময়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
শিহাবের এমন আকস্মিক মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন তার মা ও বাবা। পড়ে গেছেন অকূল সাগরে। বাকরুদ্ধ বাবার নিরবতা ও মায়ের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে বাড়ির পরিবেশ। গত ১৯ জুলাই শুক্রবার রাতে গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার সন্যাসীর চর ইউনিয়নের রাজারচর আজগর হাওলাদারকান্দি গ্রামে মরদেহ এসে পৌছাঁলে শোকের মাতম ওঠে। পরে ২০ জুলাই শনিবার তার দাফন সম্পন্ন হয়। তবে এখনও পর্যন্ত সরকারি বেসরকারি কোন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা পায়নি পরিবারটি।
সরেজমিনে শহিদ শিহাবের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সন্তান হারিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন মা নাছিমা বেগম। শোকে বাকরুদ্ধ বাবা নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকছেন ঘরের এক কোনে। একমাত্র ভাইকে হারিয়ে আর্তনাদ করে উঠছেন বোন। শোকে আচ্ছন্ন স্বজন-প্রতিবেশী। বাড়ির পাশের কবরস্থানে এসে ভিড় করছেন স্বজনেরা।
একমাত্র নাতিকে হারিয়ে প্রলাপ বকছেন দাদা রফিক হাওলাদার।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার বাড্ডার লিংকরোড এলাকার ফুপাতো ভাই মনির মোল্লার 'হাসান স্টিল এন্ড ফার্নিচার' এ কাজ করতেন শিহাব। গত ১৯ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে মনির মোল্লার বোনের বাসায় দুপুরের খাবার খেতে যান তিনি। খাবার শেষ করে পাশেই কারখানাতে (ফার্নিচার) ফিরছিলেন শিহাব। রাস্তা পার হতে গিয়ে দেখেন টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে সড়ক। তখনই একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় শিহাবের শরীরে। বুকের বাম পাশ দিয়ে বিদ্ধ হয়ে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায় গুলি।
তখন ওই এলাকার মসজিদের এক ইমাম (পূর্ব পরিচিত) সাথে ছিল শিহাবের। তিনি খবর দেন ফার্ণিচারের দোকানে। পরে খবর পেয়ে দোকানের মালিক ফুপাতো ভাই মনির মোল্লা স্থানীয় এক হাসপাতালে গিয়ে শিহাবকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। চিকিৎসা না পেয়ে বনশ্রী এলাকার নাগরিক স্পেশালাইজড প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মনির মোল্লা বলেন,'শিহাব আমার দোকানে কাজ করতো। দুপুরে খাবার খেয়ে কারখানায় ফেরার সময় সে গুলিবিদ্ধ হয়। বুকের এক পাশ থেকে গুলি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। হাসপাতালে চিকিৎসা পায়নি। ভর্তি করতে চায়নি কোন হাসপাতাল। চোখের সামনে সব শেষ হয়ে গেলো।’
নিহত শিহাবের চাচা সাহাবুদ্দিন হাওলাদার বলেন,‘আমাদের পরিবারের একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল শিহাব। আমার বড় ভাইয়ের ছেলে। তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিল শিহাব। এখন পরিবারটি নিঃস্ব। কে দেখবে তাদের?’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিহত শিহাবের মা নাছিমা বেগম বলেন,‘আমার ছেলে দুপুরে খাইয়া কারখানায় যাইতেছিল। ওরে কেন গুলি কইরা মারলো? আমার একমাত্র ছেলে। আমি এখন কি নিয়া বাঁচমু। আমার বাবার কাছে আমারে নিয়া যাও।’
জানতে চাইলে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন আক্তার বলেন,বিষয়টি মর্মান্তিক। আমি খোঁজ খবর নিচ্ছি। ওই পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবো।