বাসস
  ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৫
আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫১

মায়ের ওষুধ কিনতে গিয়ে শহিদ হন ব্যাংক কর্মকর্তা দুলাল মাহমুদ

॥ বরুন কুমার দাশ ॥

ঢাকা, ৯ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : নিদারুণ আর্থিক কষ্ট আর দারিদ্র্যকে মাড়িয়ে সবেমাত্র এক যুগ হলো সুখের মুখ দেখেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা দুলাল মাহমুদ। বাবা-মা, স্ত্রী আর দুই ফুটফুটে সন্তানকে নিয়ে পেতেছিলেন সুখের সংসার। তবে সে সব আজ শুধুই স্মৃতি। ঘাতক বুলেটের আঘাত কেড়ে নিয়েছে গোটা পরিবারটির হাসি।

দুলাল মাহমুদ ছিলেন স্ট্যান্ডার্ড চ্যার্টার্ড ব্যাংক কারওয়ান বাজার ব্রাঞ্চের সিনিয়র ম্যানেজার।

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে আজিমপুরের নিজ বাসার সামনেই গুলিবিদ্ধ হন দুলাল মাহমুদ(৩৮)। পরে ১৯ জুলাই ভোর ৬ টা ২০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ওইদিনই গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার চরখাগুটিয়া চৌকিদার কান্দি গ্রামে তাকে দাফন করা হয়। দুলাল ওই গ্রামের সিদ্দিক খালাসী ও জুলেখা বিবি’র সন্তান। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে দুলাল মাহমুদ ছিলেন চতুর্থ।

সম্প্রতি রাজধানীর আজিমপুরের সরকারি কোয়াটার্রের ৪ নং ভবনে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমন কথা জানান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত ব্যাংক কর্মকর্তা দুলাল মাহমুদের স্ত্রী স্কুল শিক্ষিকা ফারহানা রহমান।

বাসস-এর এই প্রতিবেদক বাসায় গেলে শহিদ দুলালের ছোট মেয়ে ফাতিহা মাহমুদ আরিশা এসে দরোজা খুলে দিয়ে প্রতিবেদকের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যায়, কি যেন হারিয়ে গেছে তার। পরে ছেলে ফারাজ মাহমুদ আদিয়াতও আসে। একটু আগেই স্কুল থেকে বাসায় ফিরেছে সে। আজিমপুর লিটলস্ এঞ্জেলসের ১ম শ্রেণীর ছাত্র আদিয়াত। ছেলে-মেয়ে দুটোর মুখে হাসি নেই।  বাবা হারানোর শোকে তাদের চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। এখনও তারা পুলিশের কথা শুনলেই আঁতকে ওঠে।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে ফারহানা রহমান জানান, ‘ঘটনার দিন বিকেল ৪ টায় অফিস থেকে বাসায় ফেরেন দুলাল।

সেদিন ছিল তার জন্মদিন। তাই ছেলে-মেয়েদের সাথে বিকেলে নাস্তা শেষ করে মায়ের জন্য ওষুধ আনতে বাইরে বের হওয়ার কথা বলেন তিনি। এর আগে মাকে ডায়াবেটিস-এর ইনসুলিন দেয়। কলোনির মধ্যে অনেক ঝামেলা হচ্ছে তাই তাকে আমি বের না হওয়ার জন্য বলি। তখন সে বলে এই তো যাবো আর চলে আসবো। পাশের দোকানে আমার একটা জরুরি ফাইল আছে, সেটাও আনতে হবে। আগামীকাল অফিসে নিয়ে যেতে হবে।’

ফারহানা রহমান বলেন, ‘আমি তাকে বলি কলোনিতে অনেক ঝামেলা হচ্ছে, বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। এই বলে আমি ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় যাই নিচে কি হচ্ছে দেখতে। এর মধ্যে আমাকে কিছু না জানিয়ে সে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। চার দিকে তখন অন্ধকার, নিচে তখন কি অবস্থা চলছিল তা উপর থেকে দেখা যাচ্ছিল না। চারদিকে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। টিয়ারসেলের কারণে চোখ জ্বালাপোড়া করছিল। এর কয়েক মিনিট পরে (রাত ৯ টা ৫ মিনিটে) দুলালের ফোন থেকে ফোন আসে, বলে ‘আমার গুলি লাগছে’। তখন আমি চিৎকার করে উঠি এবং দৌড়ে নিচে চলে যাই। এই শুনে বাচ্চা দুটো হাইমাউ করে কান্না শুরু করে।’

তিনি বলেন, বাসার নিচে আমার চিৎকার শুনে কয়েকটা ছেলে এসে বলে, ওই বিল্ডিং এর নিচে একজনের গুলি লাগছে। গিয়ে দেখি আমার স্বামী পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার চারপাশ। আমার চিৎকার শুনে আশে পাশের মানুষ এসে আমার ওড়না দিয়ে তার গুলি লাগার স্থানে (কোমর) শক্ত করে বেঁধে ফেলে। হাত দুটোর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। গুলিতে হাত দুটো ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। পরে আমি আমার ভাইকে ফোন করি। সে আসলে পর তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

প্রথমে তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল জানিয়ে শহিদ দুলাল মাহমুদের স্ত্রী জানান, আমরা প্রথমে তাকে ল্যাডএইড হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে তাকে চিকিৎসা দিতে আপারগতা জানায় কর্তৃপক্ষ। পরে সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। এর মধ্য অনেক রক্তক্ষণ হয় আমার স্বামীর। এই সময়ে বড় সমস্যায় পড়ি রক্ত সংগ্রহ করা নিয়ে। তার রক্তের গ্রুপ ছিল ‘ও’ নেগেটিভ। ওই সময়ে কে রক্ত দিতে আসবে বলেন? তারপরও কোন ভাবে এক ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করে তাকে দেওয়া হয়। পরে ডাক্তাররা তার জরুরি অপরেশন করার কথা জানান এবং রক্তের ব্যবস্থা করতে বলেন। প্রায় দীর্ঘ সাত ঘন্টা  পরে তার অপরেশন শুরু হয়। অপরেশন চলাকালে তার হার্টঅ্যাটাক হয়। চিকিৎসকরা ভোর ৬ টা ২০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ল্যাবএইড হাসপাতাল যদি ওই সময়ে চিকিৎসা শুরু করতো তাহলে আমার স্বামীকে বাঁচানো সম্ভব হতো।

দুলাল মাহমুদ ১৯৮৪ সালের ১৮ জুলাই শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের চরখাগুটিয়ার চৌকিদারকান্দি গ্রামে জন্ম নেন। তিনি ২০০১ সালে পূর্ব নাওডোবা পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। পরে মুন্সিগঞ্জ থেকে শেষ করেন উচ্চ মাধ্যমিক। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। ২০১৩ সালে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকে চাকরি হয় তার। ২০১৬ সালে বরিশাল জেলার গৌড়নদী উপজেলা বাসিন্দা স্কুল শিক্ষিকা ফারহানা রহমানের সাথে পারিবারিক ভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন দুলাল। বর্তমানে তার সংসারে সাত বছরের আদিয়াত ও সাড়ে তিন বছরের আরিশা নামের দুটি সন্তান রয়েছে। ঢাকার আজিমপুরে স্ত্রী, দুই সন্তান ও অসুস্থ মা-বাবাকে নিয়ে বসবাস করতেন দুলাল মাহমুদ।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ফারহানা রহমান বলেন, দুলাল নিচে যাওয়ার পরে পুলিশ ও ছাত্রদের মাঝে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। তখন সে পাশের ২৩ নম্বর ভবনের নিচে আশ্রয় নেয়। এর মধ্যে দারোয়ান গেট বন্ধ করে দেয়। পরে পুলিশ গেটের পাশে গিয়ে তাকে গেট খোলার কথা বলে। সে জবাবে বলে, আমি তো পাশের বিল্ডিং এ থাকি, এই গেটের চাবি আমার কাছে নেই। তখন পিছন থেকে এক পুলিশ তার কোমরে একাধিক গুলি করে। পরে আরেক পুলিশ তার হাতে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয়। তখন সে নিচে পড়ে যায়।

এ সময়ে তিনি কান্না করতে করতে বলেন, তাঁদের সুখের সংসারে এমন পরিস্থিতি কেন হলো? তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তা কে দেবে?

‘আমার স্বল্প আয়ের সংসার কিভাবে চলবে? ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যত কি হবে?’ এমন প্রশ্ন করে তিনি আবার কাঁদতে থাকেন।

শহিদ দুলাল মাহমুদের ভায়রা ভাই (স্ত্রীর বড় বোনের স্বামী) খোন্দকার সালাম মাহমুদ বাসসকে জানান, সে আমাকে একদম বড় ভাইয়ের মত শ্রদ্ধা করতো। যে বয়সে ছেলে মেয়ে দুটোর তাদের বাবার পিঠে চড়ে খেলা করার কথা, সে সময়ে তারা বাবা কে হারিয়েছে। ছেলে-মেয়ের দুটোর মুখের দিকে তাকাতে পারি না।

তিনি বলেন, ঘটনার দিন সারা ঢাকা জুড়ে আন্দোলন চলছিল। দুলালের মৃত্যুর খবর শুনে কোন আত্মীয় স্বজন তার বাসার দিকে যেতে পারছিলো না। পরে অনেক কষ্ট করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভোর রাতে ঢাকা মেডিকেলে যাই। একটু পরে অপারেশন শুরু হয়।

যখন তাকে অ্যানেস্থিশিয়া দেওয়া হয়, তখন তার হার্ট অ্যাটাক হয়ে মৃত্যু হয়। এর পরে চিকিৎসকরা মৃত্যুর সনদে লেখে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু। পরে এই নিয়ে অনেক ঝামেলা পোহােেত হয়েছে। সবশেষে অনেক বাগবিত-া করে মৃত্যু সনদে পরিবর্তনে বাধ্য করি। শেষে গুলিতে মৃত্যুর কারণ লেখা হয়।

ছেলে দুলাল মাহমুদের এমন করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না মা জুলেখা বিবি। তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকে ছেলেটাকে দুইটা টাকা দিতে পারি নাই। মানুষের দোকানে কাজ করে পড়ালেখা করছে।

এখন সে চাকরি পাইছিল। কিন্তু আমার নির্দোষ ছেলেটারে মাইরা ফেলল। আমার বুক খালি কইরা, আমার নাতি-নাতনীদের এতিম বানাইয়া দিল। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।

দুলালের ছোট ভাই জসিম খালাসী বলেন, টাকার অভাবে আমরা ভাইরা আর কেউ পড়াশোনা করতে পারি নাই। দুলাল ভাই নিজে পড়াশোনার জন্য ভ্যান চালাইছে, মানুষের বাড়িতে কাজ করছে। তিনিই আমাদের দেখাশোনা করতেন। আজ তিনি আর নাই।

আমাদের একটাই দাবি ভাইয়ের পরিবারটির পাশে যেন সরকার দাঁড়ায়।

আজিমপুর কলোনীর বাসিন্দা আজিজ আহমেদ বলেন, দুলাল ভাই কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এমনকি বেশি মানুষের ভিড় কিংবা আড্ডা পছন্দ করতেন না। তার এমন মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না।

শহিদ দুলাল মাহমুদের স্ত্রী বলেন, আসলে সেদিনের অবস্থা ও কষ্টের কথা বলা খুবই কঠিন। ছেলে মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আর কোন পরিবারকে যেন এমন সমস্যায় পড়তে না হয় আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি। মেয়েটা সব সময় আকাশের তারা দেখিয়ে বলে, ‘আম্মু আম্মু দেখো ওই যে আব্বু। আকাশের তারা হয়ে গেছে।’ তাদের ট্রমা এখনও কাটেনি। ঘুমের মাঝে আঁতকে ওঠে।

আমার স্বামী আমার পরিবারের লক্ষ্মী ছিলেন জানিয়ে ফারহানা রহমান বলেন, মানুষ বলে বাড়ির বউরা হয় ঘরের লক্ষ্মী। কিন্তু আমার স্বামী ছিলেন আমার ঘরের লক্ষ্মী। আমাকে সকল কাজে সগযোগিতা করতেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসতেন। আমি অফিসে চলে যেতাম। পরে মেয়েকে ঘুম থেকে উঠিয়ে, ফ্রেশ করে, খাবার খাওয়াতেন। এর পরে নিজের অফিসে যেতেন। আমার সকল সময় খোঁজ খবর রাখতেন। কখন কি লাগবে তার সব কিছু জানা ছিল।

আন্তর্বর্তীকালিন সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে তিনি জানান, বাচ্চাদের নিরাপদ ভবিষ্যত চাই। ওদের সঠিক ভাবে পড়া লেখা শেখাতে চাই। কিন্তু আমার এই অল্প আয়ে তা সম্ভব নয়। আমার বেতনের অধিকাংশ বাসাভাড়ায় কেটে নেয়। বাকি যা পাই তা দিয়ে সংসার চালানো, ছেলে মেয়ের লেখাপড়া শেখানো সম্ভব নয়। তাই সরকারের প্রতি আহবান, ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে সরকার যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পাশাপাশি যারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন রাষ্ট্রীয় ভাবে সবাইকে শহিদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।