শিরোনাম
॥ আবদুস সালাম আজাদ জুয়েল ॥
চাঁদপুর, ৯ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : মো. হাসান সিকদারের জন্ম খুবই দরিদ্র পরিবারে। চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার কড়ইয়া ইউনিয়নের তুলাতলি গ্রামের সিকদার বাড়ির কবির হোসেনের ছেলে হাসান দ্বাদশ শ্রেনীতে অধ্যয়নরত ছিলেন। বয়স হয়েছিল মাত্র ১৮ বছর। নিজের পড়া ও সংসারের খরচ যোগান দিতে কয়েকমাস আগে রাজধানীর বসন্ধুরা আবাসিক এলাকার প্রবেশ পথে একটি বইয়ের দোকানে কাজ নেন। গত ১৮ জুলাই বেলা ১১টার দিকে কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন। মাথায় ও চোখে গুলিবিদ্ধ হাসান একইদিন রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
সম্প্রতি হাসানদের বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের সাথে কথা বলার পর এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। হাসানের পিতা কবির হোসেন একজন শ্রমিক। তবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে এখন কর্মক্ষম নন। হাসানের মা হালিমা বেগম গৃহিণী। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট এক বোন কচুয়া বঙ্গবন্ধু সরকারি ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে এবং ছোট বোন স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। পরিবারে উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায় বাধ্য হয়ে হাসান কাজে যোগ দেয়। শিক্ষিত হয়ে সংসারের হাল ধরবেন এবং বাবা-মার স্বপ্ন পুরণ করার পরিকল্পনা থাকলেও তা করার সুযোগ পেলেন না। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে তার সকল স্বপ্ন ভেঙে চুরামার হয়ে গেল।
হাসানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মো. তারেক বাসসকে বলেন, আমি ও হাসান মনোহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মনোহরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে একসাথে পড়েছি। এসএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমি কচুয়া বঙ্গবন্ধু সরকারি ডিগ্রি কলেজ এবং হাসান রহিমানগর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়। একাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর হাসানদের সংসারে অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। কারণ তার বাবা এলাকায় কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্থানীয় লোকদের সহযোগিতায় তার বাবার চিকিৎসা খরচের যোগান হয়। এ বছর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আগে আমি এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করলেও কাজে যোগ দিতে ঢাকায় চলে যায় হাসান। তাকে পরীক্ষা দেয়ার অনুরোধ করলেও সংসারের নানা অভাবের কথা বলে খুবই দু:খ প্রকাশ করে হাসান। তাকে আমি পরীক্ষার খরচের ব্যবস্থা করে দিব বলে অনুরোধ জানাই। কিন্তু হাসান আমাকে পরিবারের প্রয়োজনটা বুঝাতে সক্ষম হয়। যে কারণে সে ঢাকা চলে যায়।
তারেক আরও জানান, হাসানের সাথে আমার অনেক স্মৃতি। আমরা দু’জন সব সময় একসাথে চলতাম। আমাদের ফুটবল খেলার আগ্রহ ছিলো বেশী। স্থানীয়ভাবে ফুটবল খেলার আয়োজন হলে একসাথে খেলায় অংশগ্রহণ করতাম। কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে সে বাড়িতে এসেছিল। তখনও আমরা একসাথে ফুটবল খেলেছি। বিশেষ করে ঢাকায় যাওয়ার পরে হাসান আমার সাথে সংসার, বোনদের পড়ার খরচ, বাবার চিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে আলাপ করতো। সবশেষ ঢাকায় যখন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলমান তখন আমাকে পরিস্থিতি নিয়ে ম্যাসেজ দিত। আমি তাকে সতর্ক থাকার জন্য পরামর্শ দিতাম।
হাসানের চাচা মোশারফ সিকদার জানান, পরিবারটি খুবই নিরীহ এবং দরিদ্র। তবে হাসান ছোট বেলা থেকেই মেধাবী হওয়ার কারণে তাকে আমরা আদর করতাম। তার পড়ালেখা যেন বন্ধ না হয়ে যায় সে কারণে সকলের সহযোগিতায় তার পড়ার খরচের ব্যবস্থা হয়। এরই মধ্যে তার বাবা কবির হোসেন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। হাসানদের বসতঘর ছিলো খুবই ছোট। লোকজনের সহযোগিতায় একটি ঘর করে দেয়া হয়। তার বড় বোনের বিয়েতেও সকলে সহযোগিতা করে।
তিনি বলেন, হাসানের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিবারের খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। কবির হোসেন প্রায় সময় তার নানা সমস্যার কথা আমাদের কাছে বলতেন। ছেলেকে নিয়ে খুবই চিন্তা করতেন। ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু এভাবে হাসানের মৃত্যু হবে কেউ কল্পনাও করেনি। হাসানের মৃত্যুর খবর জানার পর এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মরদেহ বাড়িতে এনে দাফন করার খরচও আমাদের ব্যবস্থা করতে হয়। এরপর তার জন্য দোয়ার আয়োজন করা হয়। সেই খরচও বাড়ির লোকজন ব্যবস্থা করে। সরকারিভাবে হাসানের পরিবারের খোঁজ নিতে এখন পর্যন্ত কেউ আসেনি। দরিদ্র এই পরিবারের সহযোগিতায় সকলের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
হাসানের ছোট বোন লিমা জানান, ভাইয়ার সাথে আমার সবচাইতে বেশি কথা হত। ঢাকায় যাওয়ার পর বেশিরভাগ সময় ইমোতে ফোন দিত। সর্বশেষ ১৭ তারিখে আমার সাথে কথা হয়। ওই দিন বিকেলে ফোন দেয়। আমার সাথে কথা বলে। রাতে আম্মার সাথেও কথা হয়। পরের দিন ১৮ জুলাই সকালে আমি মোবাইলে ম্যাসেজ দিই। কিন্তু কোন উত্তর আসে না। ওইদিনই বেলা ১১টার দিকে ভাই তার কর্মস্থল থেকে বের হলে গুলিবিদ্ধ হয়। দুপুরে আড়াইটার দিকে আমরা খবর পাই। এরপর মা-বাবা সবাই ঢাকায় চলে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজে গিয়ে ভাইকে আহত অবস্থায় দেখতে পায়।
হাসানের মা হালিমা বেগম ছেলের মৃত্যুর নির্মম অবস্থার কথা বর্ণনা করার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তার চোখে মুখে এখন অনিশ্চয়তার ছাপ।
তিনি জানান, ছেলে আমার মেধাবি ছিলো। সংসারের হাল ধরার জন্য এ বছর পরীক্ষা না দিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কের কাছে একটি বইয়ের দোকানে কাজ নেয়। ঢাকায় থাকলেও আমাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমরা প্রতিবেশী একজনের মাধ্যমে খবর পাই। তিনি জানান ঢাকা মেডিকেলে আছে হাসান। এরপর ঢাকায় রওয়ানা হই। আন্দোলনের কারণে কাঁচপুর ব্রিজের পরে আর যেতে পারিনি। তার বাবাসহ পায়ে হেঁটে হাসপাতালে যেতে হয়। হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার ছেলে আইসিইউতে। চিকিৎসকরা বলছিলেন ৭২ঘন্টা দেখবে। প্রথমে তার মাথায় অপারশেন এবং পরে চোখে অপারেশন করবে। কিন্তু তার আগেই অর্থাৎ ১৮ জুলাই দিনগত রাত পৌনে ১০টার দিকে ছেলে মারা যায়। পরে বাড়িতে এনে তার দাফন করি।
তিনি জানান, আমার ছেলে তার অনেক স্বপ্নের কথা আমাদের সাথে বলেছে। প্রায় সময় বলত মা আমি বিদেশে যাব। তখন টাকা রোজগার হলে তোমাদের আর কষ্ট থাকবে না। বোনদের বিয়ে দিতে পারবো। বড় বোনকে সহযোগিতা করবো। বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে। আমাদের ঘর তৈরি হবে। এখন এসব স্বপ্ন আমাদের স্বপ্নই রয়ে গেলো।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমার ছেলের দাফনের পরে বাড়িতে মিলাদ হয়েছে। সেখানে গরীব লোকদের খাওয়ানো হয়েছে। কিন্তু আমি এক অভাগা মা। ছেলের এই আয়োজনে এক কেজি চালও দেয়ার সামর্থ আমার ছিলো না।
এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহিদ হাসানের মা।