বাসস
  ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:৩৮
আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১৮:৫৪

জমি ও বসত ভিটা বন্ধক রেখে চলছে আহত রিপনের চিকিৎসা

 

প্রতিবেদন : মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী

সুনামগঞ্জ, ১০ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : চলতি বছরের ৪ আগস্ট। দিনটি ছিল রোববার। সরকার পতনের একদফা দাবিতে সারা দেশের মতো উত্তাল সুনামগঞ্জও। সকাল থেকেই দিনটি ছিল থমথমে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা দখলে নেয়। ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আরো যোগ দেন ২০ বছর বয়সী থাই অ্যালুমিনিয়াম মিস্ত্রি রিপন মিয়াও। এদিকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগও ট্রাফিক পয়েন্ট এলাকায় দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়।

বেলা সাড়ে ১১ টায় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের একদফা দাবিতে ছাত্র-জনতা শুরু করে বিক্ষোভ মিছিল। মিছিলটি শহরের ট্রাফিক পয়েন্টে যাওয়ার পথে কামারখাল এলাকায় পৌঁছানোর পর শুরু হয় পুলিশের এ্যাকশন। পুলিশ নির্বিচারে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ছুঁড়তে থাকে। টিয়ারশেল আর রাবার বুলেটের শব্দে প্রকম্পিত হয় পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকা।

পুলিশের বেপরোয়া টিয়ারশেল আর রাবার বুলেটের মুখে টিকতে না পেরে ছাত্রজনতা পিছু হটতে থাকে। তারা পিছু হটে জেলা সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের কালেক্টরেট এলাকায় অবস্থান নেয়। পুলিশের টিয়ারশেলের ধোঁয়া আর ঝাঁঝে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে জেলা কালেক্টরেট এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়।

ছাত্র-জনতার একটি দল শহরের আরপিন নগর গলির ভেতর ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। এতেও রক্ষা হয়নি ছাত্র-জনতার সাথে আন্দোলনে যোগ দেয়া রিপন মিয়ার। আরপিন নগর ঈদগাহ এলাকায় একটি সিএনজি চালিত অটো রিকশার মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু সেখান থেকে তাকে বের করে এনে পায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করেন সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার তৎকালিন ওসি খালেদ চৌধুরী।


সম্প্রতি সুনামগঞ্জ শহরতলী বদিপুর মাউজবাড়ি গ্রামে রিপনের বাড়ি গিয়ে জানা গেছে এসব তথ্য।

সেদিনের ভয়াবহ ও করুণ চিত্রের বর্ণনা দিয়ে রিপন বাসসকে জানান, গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার সাথে আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। পুলিশের গুলি ও টিয়ারশেলের মুখে টিকতে না পেরে অন্যান্য আন্দোলনকারিদের সাথে তিনিও আরপিন গলির ভেতর ঢোকেন। এ সময় তিনি আরপিন নগর ঈদগাহ এলাকায় একটি সিএনজি চালিত অটো রিকশায় লুকিয়ে পড়েন। কিন্তু বিধি বাম। অটো রিকশার ভেতর থেকে তাকে টেনে বের করে পুলিশ। তার পায়ে বন্দুক  ঠেকিয়ে গুলি করেন ওসি খালেদ।

রিপন আরও জানান, তার পায়ে ওসি খালেদ গুলি করার পর তিনি মাটিতে গড়াগড়ি করলেও তাকে হাসপাতালে নেয়ার মতো কেউ এগিয়ে আসেনি, পুলিশের ভয়ে। মাটিতে গড়াগড়ির এক পর্যায়ে তিনি নিজের গায়ের গেঞ্জি খুলে গুলিবিদ্ধ পা বাঁধেন। এ সময় এক রিক্সা চালক এগিয়ে এসে তাকে এ অবস্থায় সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যার সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। খবর পেয়ে তার মা আছর বিবি ছুটে যান হাসপাতালে। সেখান থেকে তাকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে কর্তব্যরত চিকিৎসক।

তিনি জানান, প্রায় ১০ দিন সিলেট ওসমানী মেডিকেলে চিকিৎসার পর তার পায়ে ইনফেকশন দেখা দেয়। পরে তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকায় তৎকালিন শেখ হাসিনা বার্ণ এ- প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতালে। সেখানে তার পায়ে অপারেশন হয়। অপারেশনের পর তাকে আবার সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ওসমানীতে আরও কিছুদিন ভর্তি থাকার পর কোন কাজ হচ্ছে না দেখে তিনি ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই হাসপাতালে তার পায়ে রিং পরানো হয়।  রিং পরাতে খরচ হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা।

রিপন আরও জানান, চিকিৎসা করাতে গিয়ে তারা জমি ও বসতঘর এক বছরের জন্য সাড়ে চার লাখ টাকায় বন্ধক দেন। এছাড়াও বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন। স্থানীয় একজন সাংবাদিক বাংলাদেশ হেল্থ ইকনোমি নামের সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

রিপনের মা আছর বিবি(৪০) বাসসকে জানান, রিপন কেবল পরিবারের বড় ছেলেই না সে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিও। তার বাবা বিগত আট বছর ধরে অসুস্থ। কাজকর্ম করতে পারেন না। ছেলে রিপনের ওপর পরিবারের ভরসা।

তাদের তিনটি মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে রোজিনা বেগমের গতবার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে পরীক্ষা দিতে পারেনি। দ্বিতীয় মেয়ে রুবি বেগম পাশর্^বর্তী আমবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়ে সুমি আক্তার সুনামগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুল এ- কলেজের নবম শ্রেণিতে পড়ে।

আছর বিবি আরও জানান, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আহত হয়ে পড়ে থাকায় তারা সকলেই বিপাকে আছেন। চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না। কিভাবে ছেলের চিকিৎসা করাবেন, কিভাবে পরিবার চালাবেন।

রিপনের বাবা কামাল উদ্দিন(৪৫) বাসসকে জানান, তিনি বিগত আট বছর ধরে অসুস্থ। কোন কাজ করতে পারেন না। ছেলেটা কাজ করে সংসার চালাতো। তার রোজগার দিয়ে ঘরটা কোনভাবে ইটের গাঁথুনি দিয়েছি। ছেলের চিকিৎসা করাতে ঘরসহ বসত ভিটা বন্ধক দেয়া হয়েছে। এক বছরের মধ্যে বন্ধক ছুটাতে হবে।

তিনি আরও জানান, রিপনের পায়ে রিং পরানো রয়েছে। তিন মাস পর অপারেশন করে আবার রিং খুলতে হবে।

রিপনের চিকিৎসা খরচ বহনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান রিপনের বাবা কামাল উদ্দিন।

এদিকে সুনামগঞ্জ জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল ইসলাম রাজু ও জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম বাসসকে জানান, সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদল চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে।