বাসস
  ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০৮
আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৮

সৌন্দর্য সচেতন খোকনের চেহারা এখন আঁৎকে ওঠার মতো

 

প্রতিবেদন : বরুন কুমার দাশ

ঢাকা, ১১ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : সৌন্দর্য সচেতন খোকন নিজের চেহারা নিয়ে বরাবরই সচেতন ছিলেন। বিশেষ করে মুখে যাতে কোনো দাগ না পড়ে, তা নিয়ে তাঁর ভাবনার কোন অন্ত ছিল না। অথচ এখন তার চেহারা আঁৎকে ওঠার মতো। তাকানো পর্যন্ত যায় না। তার দিকে তাকিয়ে ভয় পাবেন অনেকেই। এমনকি খোকন নিজেই ভয় পান নিজের চেহারা দেখে। 

পুলিশের নির্মম নিষ্ঠুরতায় আজ খোকনের চেহারার এই ভয়ংকর দশা। এমনকি খোকনের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাও এখন অনিশ্চিত। তাঁর দুই পায়ের গুলিও বের করা সম্ভব হয়নি। 

খোকনের কাছে গিয়ে দেখা গেলো তিনি বাম চোখে কিছুই দেখেন না। ডান চোখটিও বন্ধ হওয়ার পথে। মুখ প্রায় মিলে গেছে আরেক চোখের সঙ্গে। মুখের ওপরের পাটির দাঁত নেই। নিচেরও কয়েকটি দাঁতও ফেলে দিতে হয়েছে। এভাবেই বেঁচে আছেন পেশায় প্রাইভেটকার চালক ২৩ বছরের খোকন চন্দ্র বর্মণ। 
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক দফা দাবিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি চলাকালে গত ৫ আগস্ট দুপুরের দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন খোকন। কাছ থেকে পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে তাঁর এ করুণ অবস্থা হয়েছে।

সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের শয্যায় বসে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় খোকন চন্দ্র বর্মণের। 

তিনি বলেন, ‘এখন আমি আমার চেহারা দেখে নিজেই ভয় পাই। এর চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো ছিল। এই কষ্ট থেকে আমি মুক্তি চাই। আর কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। সরকার শুধু বলছে, আমাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠাবে। দুই মাস পার হয়ে গেল, বিদেশে পাঠাতে এত সময় লাগে? সরকার চাইলে আমাকে দ্রুত বিদেশে পাঠাতে পারে না?’

খোকন শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার নালিতাবাড়ি গ্রামের কিনা চন্দ্র মন্ডল ও মা রীনা রানী দাসের মেজো সন্তান।  বাবা কিনা চন্দ্র বর্মণ খাবার সরবরাহ করেন। এ কাজে তিনি মাসে পান ১০ হাজার টাকা। আর মা রীনা দাস গৃহকর্মীর কাজ করে মাসে পান ছয় হাজার টাকা। সেই টাকায় এখন তাদের সংসার চলছে। খোকনের ছোট ভাই শুভ চন্দ্র বর্মণ চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। পেশার কারণে খোকন থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। পরিবারের অন্যরা থাকেন রাজধানীর মহাখালী। খোকনের বড় ভাই খোকা চন্দ্র বর্মণও পেশায় প্রাইভেটকার চালক। ভাইয়ের চিকিৎসায় পাশে থাকতে গিয়ে তাকেও চাকরি ছাড়তে হয়েছে। 

হাসপাতালে খোকনের শয্যার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর মা রীনা রানী দাস। 

তিনি বলেন, ‘মা হয়ে আমি নিজেই চিনতে পারি না আমার ছেলেকে। কী সুন্দর ছিল আমার ছেলেটা। সব সময় চেষ্টা করত মুখের মধ্যে কোনো দাগ যেন না লাগে। সেই ছেলের কী চেহারা হইল। আমি ওর মা, তাই ওকে দেখে ভয় পাই না। কিন্তু ছেলে নিজের চেহারা আয়নায় দেখে কান্নাকাটি করে। সরকার তাড়াতাড়ি ওরে একটু বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারে না?’

তিনি বলেন, গুলি লাগার দুই মাস আগেও খোকন আমাকে বলেছিলো, অন্যের বাড়িতে আমাকে আর কাজ করতে দেবে না। গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে। তারা দুই ভাই গাড়ি চালিয়ে যা আয় করবে, তা দিয়ে সংসার চলে যাবে। আর এখন খোকনেরই এই অবস্থা।

সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, খোকনের জিব তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। খোকন অল্প অল্প কথা বলতে পারেন। যা অস্পষ্ট হলেও বোঝা যায়। না বুঝলেও খোকন আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেন। নিজেই বর্ণনা করেন ওই দিনের ঘটনা।

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে খোকন বর্মণ জানান, গত ৫ আগস্ট সকালে নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে বের হন তিনি। যুক্ত হন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে। সাইনবোর্ড পর্যন্ত এলে সেখানে দায়িত্বরত বিজিবি তার পথ আটকে দেয়। তারা বিজিবির বাধা ভেঙে রওনা দেন যাত্রাবাড়ীর দিকে। বেলা ১২টার দিকে পৌঁছান যাত্রাবাড়ী। সেখানে আবার বাধার মুখে পড়েন। যাত্রাবাড়ী  থানার সামনে থেকে পুলিশ গুলি চালানো শুরু করে। এ সময় গুলিতে সাত থেকে আটজন নিহত হন।  এর কিছুক্ষণ পর শোনা যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে গেছেন। এর ২/৩ মিনিটেই পুলিশ থানা থেকে এলোপাতাড়ি গুলি চালানো শুরু করে। পুলিশের গুলিতে লোকজন ছোটাছুটি করতে থাকেন।

তিনি বলেন, থানা থেকে পূর্ব দিকে ফ্লাইওভারের একটি পিলারের পাশে গিয়ে আমরা ১৫-২০ জন আশ্রয় নেই। সেখানেও পুলিশ গুলি চালায়। তখন আমি দৌড় দেই। আর তখন আমার পায়ে গুলি লাগে। রাস্তার পাশে রাখা যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের ড্রামের পাশে গিয়ে বসে পড়ি। সেখানে গিয়েই পুলিশ আমার মুখ বরাবর গুলি চালায়। গুলি চালানোর আগে হাত জোড় করে অনুরোধ করেছিলাম যাতে গুলি না চালায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। নিষ্ঠুর সেই পুলিশ আমার মুখে গুলি চালিয়ে দেয়। আমি লুটিয়ে পড়ি। আমার মৃত্যু হয়েছে ভেবে পুলিশ সরে গেলে কয়েকজন ছাত্র আমাকে উদ্ধার করেন। এ ঘটনা বেলা আড়াইটার দিকের। তখনও আমার জ্ঞান ছিল। পরিবারকে খবর দেওয়ার জন্য ফিঙ্গার দিয়ে ফোন খুলে দেই। তারপর তারা পরিবারকে খবর দেয়। এরই মধ্যে ছাত্ররা আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

বার্ন ইনস্টিটিউটের প্লাস্টিক সার্জন সহযোগী অধ্যাপক ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, ‘খোকনের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, খুব কাছ থেকে তার মুখে গুলি করা হয়েছে। গুলিতে তার মুখের একটি বড় অংশ হাড়সহ নষ্ট হয়ে গেছে। প্রথমে খোকনকে কৃত্রিম শ্বাসনালি দিয়ে নিশ্বাস নিতে হতো। বর্তমানে কৃত্রিম শ্বাসনালি খুলে দেওয়া হয়েছে। আগে নল দিয়ে তাকে তরল খাবার খাওয়ানো হতো। এখন মুখের গর্ত দিয়ে তরল খাবার একটু খেতে পারছেন। তাঁর যে জটিল অবস্থা হয়েছে, এর চিকিৎসা দেশে সম্ভব নয়। তাই তাঁকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’ 

খোকনের বড় ভাই খোকা বলেন, ‘এমন অবস্থা ছিল আমার ভাইয়ের মুখের কিছুই বোঝা যেত না। বেঁচে থাকবে এটাই ছিল অনিশ্চিত। ঢাকা মেডিকেল থেকে পাঠানো হয় ঢাকা ডেন্টালে। সেখানে ১০ দিন চিকিৎসার পর এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। সেই থেকে এখানেই তার চিকিৎসা চলছে। শুনেছি বিদেশ নেওয়ার বিষয়ে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা সেই অপেক্ষায় আছি।’

খোকন ও তার পরিবারের এ অপেক্ষা কবে ফুরাবে এ জিজ্ঞাসা সংশ্লিষ্ট সকলের।