শিরোনাম
প্রতিবেদন : মহিউদ্দিন সুমন
টাঙ্গাইল, ১২ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : ‘তোরা যে আন্দোলন করছিস, এ আন্দোলন করে তো সরকারের পতন ঘটাতে পারবি না। কারণ শেখ হাসিনা যে কোন মূল্যে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে।’ মায়ের এমন কথার জবাবে ছেলে মা’কে বলেছিল- কি যে বল মা, তুমি দেখে নিও আর বেশি দেরি নাই, এই স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন অতি নিকটে। স্বৈরাচারের পতন হলেই আমি ঘরে ফিরবো। এটাই ছিল মায়ের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে আশরাফুল্লাহ’র মুঠো ফোনে শেষ কথা।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর সময় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আনন্দ মিছিলে ঢাকার সাভারের বাইপাইল এলাকায় টাঙ্গাইল দেলদুয়ার উপজেলার বার পাখিয়া গ্রামের মেধাবী শিক্ষার্থী আহনাফ আবির আশরাফুল্লাহ (৩০) বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন। পরের দিন ৬ আগস্ট দেলদুয়ার উপজেলার বার পাখিয়া জামে মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে স্থানীয় কবর স্থানে তাকে দাফন করা হয়।
পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার সদর বার পাখিয়া গ্রামে মৃত হারুন অর রশীদ ও আছিয়া খাতুন(৬০) দম্পতির একমাত্র ছেলে ছিল আহনাফ আবির আশরাফুল্লা (৩০)। এ ছাড়া এ দম্পতির তিন কন্যা সন্তান রয়েছে। ২০১১ সালে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার সরকারি সৈয়দ আব্দুর জব্বার বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন আশরাফুল্লাহ। এরপর তিনি মুন্সীগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ২০১৬ সালে ইলেকট্রিক্যাল বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তি হন। সেখানে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন আশরাফুল্লাহ ।
আশরাফুল্লাহ এর মেজ বোন এডভোকেট সাইয়েদা আক্তার সে দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
তিনি জানান, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটিতে পড়ার সুবাদে আবির সাভারের আশুলিয়া বুড়িরবাজার এলাকায় থাকতো। সেখানে থেকে আবির লেখাপড়ার পাশাপাশি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতো। গত ৪ আগস্ট সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সারাদিন আন্দোলনে ছিল। এরপর ৫ আগস্ট আশুলিয়া বাইপাল এলাকায় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে যুক্ত হয় সে। সেদিন আমি ওকে বারবার ফোন দিচ্ছিলাম কিন্তু আমার ফোন ধরছিল না। চারটার দিকে আবারও ফোন দেই। ফোন রিসিভ করে ভাই আমাকে বলেছিল বারবার ফোন দিচ্ছিস কেন? ফোন দিস না, ফোন ধরতে পারবো না। আমার জন্য চিন্তা করিস না আমি ভাল আছি। তখন আশরাফুল্লাহ একটা কথাই বলছিল, বিকেলের দিকে সেনাপ্রধান ভাষণ দেবেন। দেখবি একটা ভাল রেজাল্ট আসবে। এটাই ছিল আমার ভাইয়ের সাথে আমার শেষ কথা।
সাইয়েদা জানান, আবির পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতো। ওইদিনও আছরের নামাজও আদায় করেছিল। বিকেলের দিকে আমার স্বামী বুলবুল আহমেদ আমাকে ফোনে জানায়, আশরাফুল্লাহ’র বুকে গুলি লেগেছে। পরে আশুলিয়ার হাবিব হাসপাতালে আশরাফুল্লাহকে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আমার ভাই ওপারে চলে গেছেন। ওকে আর পাবো না। এটা এখনো আমার বিশ্বাস হয় না।
সাইয়েদা আরও জানান, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এদেশের মানুষ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেনি। বিগত সরকারের আমলে পুলিশ সাধারণ মানুষের সাথে পশুর মতো আচরণ করেছে। গত ৫ আগস্ট দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। আর যেন এদেশে এমন ফ্যাসিস্ট সরকারের জন্ম না হয়। সরকার আমার ভাইয়ের খুনীদের সঠিক বিচারের আওতায় আনবে এটাই আমার একমাত্র প্রত্যাশা।
উল্লেখ্য, গত ০৫ সেপ্টেম্বর আহনাফ আবির আশরাফুল্লাহ’র মেজো বোন এডভোকেট সাইয়েদা আক্তার বাদী হয়ে ৩৬ জনকে আসামি করে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেন।
আশরাফুল্লাহ’র মা আছিয়া খাতুন বাসস কে জানান, গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্বৈরাচারি সরকারের পতন হয়। কিন্তু আমার আবির হারিয়ে গেছে। আমার আবির বাড়ি ফিরেছে লাশ হয়ে। এ কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
শোকে দুঃখে কেঁদে কেঁদে চোখের জল শুকিয়ে গেছে আছিয়া খাতুনের। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তিনি এখন পাগলপ্রায়। এখন তার একটাই চাওয়া ছেলে হত্যার সঠিক বিচার। আর তার কোন চাওয়া পাওয়া নেই।
আর্থিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লক্ষ টাকা, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৪০ হাজার টাকা এবং বিএনপির পক্ষ থেকে ৪০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছে তার পরিবার।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরিফা হক বাসসকে জানান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। তাছাড়া সরকারিভাবে ঘোষণা আছে, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা করে দেয়া হবে।