বাসস
  ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৩

সন্তান চাকুরি পেলে রক্ষা পায় শহিদ সাইফুলের পরিবার

॥ বরুন কুমার দাশ ॥

ঢাকা, ১৩ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস): স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর হাজারীবাগের একটি ছোট রুমে ভাড়া থাকতেন সাইফুল। পেশায় ছিলেন প্রাইভেটকার চালক। প্রাইভেট কার চালিয়ে যা আয় হতো, তা দিয়ে স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে কোন রকমে দিন কাটতো তাদের।

কিন্তু সাইফুল শহিদ হওয়ার পর থেকে এখন তাদের টিকে থাকাই মুশকিল। আর্থিকভাবে পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে পড়েছে পরিবারটি। মানবেতর জীবন এখন তাদের। সাইফুলের স্ত্রী না পারছে সন্তানদের চিকিৎসা করাতে, না পারছে সন্তানদের ঠিক মত খাবার কিনে খাওয়াতে। আগামী মাসে বাসাভাড়া কি করে দেবেন তা নিয়েও চিন্তিত সাইফুলের স্ত্রী।

স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিজয় মিছিলে গিয়ে সাইফুল ইসলাম ৫ আগস্ট নিখোঁজ হন। পরে ৬ আগস্ট সকালে সাইন্সল্যাব মোড় থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।  সাইফুলের মৃত্যুর পর চার সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তার স্ত্রী তানিয়া। পরিবারের আর কোন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকায় সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেওয়াও কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়েছে। ছোট সন্তান দুটি অসুস্থ থাকায় তাদের চিকিৎসাও করাতে পারছেন না। আগামী মাসে কিভাবে বাসা ভাড়া দেবেন, সন্তানদের খাবার কিনে খাওয়াবেন, দুই সন্তানের স্কুলের বেতন কিভাবে দেবেন সেই নিয়ে চিন্তিত সাইফুলের স্ত্রী।

রাজধানীর হাজারীবাগের বাসায় সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমন কথা জানান শহিদ সাইফুল ইসলামের স্ত্রী তানিয়া।
তিনি বলেন, ‘খুব কষ্টের মধ্যে আছি ভাই। আমার পরিবারে রোজগার করার আর কোন লোক নেই। ওর আব্বু (সাইফুল) প্রাইভেট কার চালিয়ে যা আয় করতো, তা দিয়ে কোন রকম সংসার চলতো। আমার কাছে জমানো কোন টাকা পয়সা নেই। এখন কি করে বাসা ভাড়া দেবো, কি করে চার সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেবো এই চিন্তাতেই মারা যাচ্ছি। গত কয়েক দিন হলো আমার জ্বর। ছোট ছেলে দু’টোর পায়ে সমস্যা। পঙ্গু হাসপাতালের ডাক্তার বলেছিল নিয়মিত চিকিৎসা করাতে। কিন্তু গত চার মাস ছেলে দু’টোকে কোন চিকিৎসা করাতে পারছি না। সংসারই চলে না, চিকিৎসা করাবো কি ভাবে? সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কেউ কোন খবরও নেয়নি। আমরা কি ভাবে আছি, কি ভাবে চলছি।’

তানিয়া জানান, আন্দোলন চলাকালে সাইফুল নিয়মিত মিছিলে যেত। গত ৪ আগস্টও সে মিছিল করে রাতে বাসায় আসে। গত ৫ আগস্ট বিকেল ৪ টার সময় বাসা থেকে বের হন তিনি। যখন বের হয়, তখন বিজয় মিছিলে যাওয়ার কথা বলেই বাসা থেকে বের হয়। পরে তার সাথে আর কোন যোগাযোগ হয়নি।

অনেকরাত হয়ে গেলেও যখন বাসায় ফেরে না, ফোনেও তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না তখন আশে পাশের তার বন্ধুদের কাছ থেকে খবর নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তারা কোন খবর দিতে পারেনি। সেদিন ছোট ছেলে দুটোও খুব অসুস্থ ছিল।

শহিদ সাইফুল ইসলামের স্ত্রী তানিয়া আরও জানান, ৬ আগস্ট সকালেও যখন তার কোন খবর পাচ্ছি না, তখন আমরা সবাই তাকে খুঁজতে বের হই। পরে তার ফোন থেকে আমার কাছে একটা ফোন আসে। ফোন পেয়ে মনের মাঝে একটু স্বস্তি আসে। কিন্তু যখন অপরিচিত কন্ঠ শুনতে পাই তখন বুকের মধ্যে  কেমন যেন করে ওঠে। অজানা আশংকায় বুকটা ধুকপুক করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আশংকাই সত্যি হলো।  ফোনের ওপাশ থেকে তার নিহতের খবর পেলাম। জানালো, লাশ সাইন্সল্যাব মোড়ে পড়ে আছে। পরে আমরা ওখানে গিয়ে লাশ ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। সেখানে ময়না তদন্ত শেষে আজিমপুর কবরস্থানে ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় দাফন করি তাকে।

শহিদ সাইফুল ইসলাম ১৯৮২ সালের ৭ মে বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জের কাজিরচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কুদ্দুস শিকদার মারা গেছেন কয়েক বছর আছে। মা আমেনা বেগম (৬০) অসুস্থ অবস্থায় কোন ভাবে বেঁচে আছেন। নদী ভাঙ্গনের ফলে গ্রামের বাড়িতে সাইফুলের যেটুকু জায়গা জমি ছিল তা শেষ হয়ে গেছে। ফলে আর গ্রামের বাড়িতে তেমন যাওয়া হতো না তাদের। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সাইফুল ইসলাম ছিলেন সবার বড়।

তিনি প্রায় ২০ বছর আগে পারিবারিক ভাবে বরিশালের গৌরনদীর বাসাইল গ্রামের তানিয়াকে বিয়ে করেন। এখন তাদের ঘরে চার ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে তানভীর ইসলাম (১৮)। সে রাজধানীর রায়হান স্কুল এ্যান্ড কলেজের মানবিক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।  দ্বিতীয় সন্তান তামিম ইসলাম (১৩) স্থানীয় এক মাদ্রাসার ছাত্র। এছাড়াও ছোট দুই (যমজ) সন্তানের বয়স আড়াই বছর।

সরেজমিনে ঝিগাতলাস্থ হাজারীবাগ রোডের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, নিচ তলায় একটি বাসার একরুমে সাবলেট থাকছেন সাইফুলের ছয় সদস্যের পরিবার।

ছোট একটা রুম। তেমন কোন আলো বাতাস প্রবেশের পথ নেই। বাসার মধ্যে চুলা জ্বলছে। স্যাঁতসেঁতে একটা পরিবেশ। সাইফুলের ছোট দুই সন্তান সেখানে বসেই খেলা করছে। বাসার অবস্থা দেখলেই বুঝা যায় কি নিদারুণ কষ্টে সংসার চালাতেন সাইফুল। তারপরও স্বপ্ন দেখতেন, সন্তানরা মানুষ হয়ে তার কষ্ট দূর করবে। সে কারণেই শত কষ্ট করেও সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন সাইফুল।

শহিদ সাইফুলের বড় ছেলে তানভীর ইসলাম বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, একটু লম্বা হওয়া কারণে বাবার ইচ্ছা ছিল আমি যেন সেনাবাহিনী অথবা পুলিশে চাকুরি করি। সেই জন্য অনেক কষ্ট করেই আমাকে লেখাপড়া করিয়েছেন। কিন্তু এখন আম্মু ও তিন ভাইকে নিয়ে কি করবো বুঝতে পারছি না। আব্বু চলে যাওয়ার পরে আমাদের পরিবারের আয় রোজগারের কেউ নেই। তাই সরকারের প্রতি আমার আহবান আমাকে যদি একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দিতো, তাহলে আমি মা- ভাইদের নিয়ে খেয়ে পরে বাঁচতে পারতাম।

সাইফুল ইসলামের শ^শুর মো. রহিম খান বলেন, মেয়ে ও নাতিগুলোর মুখের দিকে তাকাতে পারি না। কি ভাবে মেয়েটা সংসার চালাবে, ছেলে গুলোকে কিভাবে মানুষ করবে? জামাই চলে যাওয়ার পরে তো আয় করার কেউ নেই সংসারে। তাই সরকারের কাছে আমার আবেদন নাতিটারে যেন একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দেয়।

সাইফুলের বন্ধু রমজান আলী জানান, সাইফুল আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। আমরা একসাথে চলতাম। সে কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলো না। গত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে গিয়ে সে নিহত হল। তার এমন মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না। চারটা সন্তান। সাইফুলের কথা মনে হলে খুব কষ্ট লাগে।

এদিকে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বিজয় মিছিলে গিয়ে সাইফুল ইসলামের নিখোঁজ হওয়া এবং পরেরদিন ৬ আগস্ট সাইন্সল্যাবে তার লাশ পাওয়ার ঘটনায় অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী তানিয়া। তিনি গত ৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে এ সংক্রান্ত অভিযোগ দায়ের করেন।