শিরোনাম
প্রতিবেদন : বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ১৫ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন ইসমাইল। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা মা। থেকে থেকে কেঁদেই চলেছেন তিনি। প্রায় চার মাস হতে চললো, তবুও কোথাও সাš¦Íনা খুঁজে পাচ্ছেন না। কান্না থামছে না অসহায় মায়ের।
ইসমাইলের মা তাসলিমা আক্তারের আহাজারিতে কেঁেপ উঠছে রাজধানীর নবীনগরের বাসার আশে পাশের মাটি ও আকাশ বাতাস। সন্তানের কথা মনে হলেই কান্না শুরু করেন তিনি। প্রতিবেশীরাও তার কান্না থামাতে গিয়ে ফেরেন অশ্রুসিক্ত নয়নে। স্বজনেরাও শোকাহত ইসমাইলের মৃত্যুতে।
প্রতিবেশিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সব সময়ে শুধু ছেলের জন্য কান্নাকাটি করেন তাসলিমা। ছেলে নিহত হওয়ার পর থেকে স্বামীর (ইসমাইলের বাবা) সাথেও কোন যোগাযোগ নেই। ইসমাইলের ছোট একটা বোন আছে। তাকে নিয়েই থাকেন তিনি। ছেলেটা জুতার কারখানায় কাজ করতো। আর মা বাসা বাড়িতে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ঢাকা উদ্যানের পাশের নবীনগরের বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমন কথা জানান ইসমাইলের স্বজন ও প্রতিবেশিরা।
ইসমাইলের মা তাসলিমা আক্তারের বয়স ৩২ বছর। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই শুক্রবার মোহাম্মদপুরের ‘আল্লাহ করিম’ মসজিদের পাশে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন মো.ইসমাইল (১৭)।
শহিদ ইসমাইলের মা তাসলিমা আক্তার বলেন, সেদিন ছিল ১৯ জুলাই শুক্রবার। সকালে ছেলেটা বেতনের টাকা তুলে নিয়ে এসে আমার হাতে দেয়। পরে আমি তাকে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দেই। আমাদের আগের বাসা ছিল কামারাঙ্গীচরে। সে নানীর বাসায় যাবে বলে বের হয়। ওর নানীর বাসা মোহাম্মদপুর ঢাকা উদ্যানের পাশে নবীনগরে।
তিনি বলেন, আমি মানুষের বাসা বাড়ি থেকে কাজ করে ফিরে এসে ইসমাইলের কোন খবর পাই না। ফোন দেই, ধরে না। পরে রাত ৯ টার দিকে ওর এক বন্ধু ফোন করে জানায়, ইসমাইল পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। খবর পেয়ে আমরা মোহাম্মদপুরে গিয়ে অনেক খোঁজাখুজি করেও লাশ পাই না। শুনি তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে রাত ১ টার সময় তার লাশ সনাক্ত করি। ২০ তারিখ ময়না তদন্ত শেষ করে ওই দিন বিকেলে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করি।
ইসমাইলের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৌরব উপজেলার জগন্নাথপুরে। তবে ইসমাইলের জন্ম কামারাঙ্গীচরেই। তার বাবা জমিস (৪০)। রশ্নি নামে ৭ বছরের একটা ছোট বোন রয়েছে ইসমাইলের। তবে ইসমাইলের মৃত্যুর পরে মা তাসলিমা ও বোন রশ্নি এখন ঢাকা উদ্যান এলাকার নবীনগরে থাকেন। কারণ ইসমাইলের নানা-নানী ও দুই মামা সেখানে বসবাস করেন। রশ্নি স্থানীয় ফুল কলি স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে পড়া লেখা করছে।
তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘সেদিন মেডিকেলে পুলিশের ভয়ে কান্না করতে পারি নাই। নিজের সন্তানের লাশ দেখে চুপ করে থাকতে বাধ্য করে পুলিশ। ছেলেটার গলায় গুলি লেগে মৃত্যু হয়। ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।’
শহিদ ইসমাইলের মা বলেন, ছেলেটা আমার ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিল। সংসারের অভাবের কারণে আর পড়ালেখা করতে পারেনি। পরে ইসলামপুরে জুতার কারখানায় কাজ শুরু করে। ওর বাবা সংসারের প্রতি উদাসিন ছিল। সে সংসারের কোন খরচ দিতো না। সন্তানটা নিহত হওয়ার পরে সে হাসপাতালে পর্যন্ত যায়নি। এরপর থেকে আমাদের সাথে কোন যোগাযোগও নেই।
সরেজমিনে রাজধানীর নবীনগরের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, নিচ তলায় একটি একরুমের বাসায় ভাড়া থাকছেন শহিদ ইসমাইলের মা ও বোন। রুমের মধ্যই রান্না ঘর। ছোট একটা রুম ভাড়া সাড়ে ৩ হাজার টাকা। রুমে তেমন কোন আলো বাতাস ঢুকার জায়গা নেই। স্যাঁতসেঁতে একটা পরিবেশ। তেমন কোন আসবাবপত্রও নেই। বাসার অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় কি নিদারুণ কষ্টে সংসার চলছে তাদের।
শহিদ ইসমাইলের মা বলেন, ছেলেডারে নিয়ে আমার তো অনেক আশা ছিল। ছেলে কাজ করে সংসার চালাবে। আমাদের অভাব-অনটন দূর করবে। সে ইচ্ছা যে, এভাবে শেষ হয়ে যাবে, তা কে জানত। এখন আমি কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবো? আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচবো? মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।
ছোট বোন রশ্নি বলেন, ‘ভাইকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। পরিবারের সবার ইচ্ছে ছিল ভাই বড় হয়ে মায়ের সব স্বপ্ন পূরণ করবে। এখন আর কেউ রইলো না আমাদের দেখার, কে দেখবে আমাকে ও আমার মাকে? কে দেবে আমার স্কুলের বেতন? কিভাবে সংসার চলবে আমাদের? সরকার যদি আমাদের দিকে তাকায়, তাহলে আমরা ভালভাবে বাঁচতে পারবো। আমিও পড়াশোনা চালাতে পারবো। আমার ভাইকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে তাদের কঠিন বিচার চাই, তাদের ফাঁসি চাই।
ইসমাইলের নানী ঝর্ণা জানান, ইসমাইল অনেক ভালো ছেলে ছিল। সে যে এভাবে গুলিতে মারা যাবে আমরা মেনেই নিতে পারছি না। যখন ওর মৃত্যুর খবর শুনতে পেলাম আমি খুবই মর্মাহত হই। ইসমাইল ছাড়া পরিবারটিকে দেখার মতো কেউ নাই। ছোট একটি বোন পড়াশোনা করছে। কে দেখবে এখন ওদেরকে? দেখার মতো কেউ রইলো না।
সরকারের কাছে দাবি, ইসমাইলের পরিবার যেন চলতে পারে সেরকম কোন একটা ব্যবস্থা করে দিক।
তিনি বলেন, নাতিটা মারা যাবার পর মেয়ে ও নাতনীকে এই এলাকায় নিয়ে এসে বাসা ভাড়া করে দিয়েছি। আমার সংসারই চলে না, ওদের দুইজনকে কিভাবে খাওয়াবো, পরাবো? আমার দুইটা ছোট ছেলে। তারাই কাজ করে সংসার চালায়। আমরাই ঠিক মত খেতে পারি না। আবার এখন ওরা দুইজন এসেছে।
নিহত ইসমাইলের মা তাসলিমা আরও বলেন, আমার ছেলে কারখানায় কাজ করে কিছু কিছু টাকা দিত। আর আমি বাসা বাড়িতে কাজ করে যা টাকা পাইতাম তা দিয়েই আমাদের সংসার চলতো। সরকার যদি আমাদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে মেয়েকে নিয়ে একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারবো। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের বিচার চাই। আমার ছেলে তো দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। তাকে যেন শহিদের মর্যাদা দেয়া হয়।
মামলার বিষয়ে তাসলিমা বলেন, আমার ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে মোহাম্মদপুর থানায় ১৫ জনের নামে মামলা করেছি। কত জনের নামে এবং কার কার নামে মামলা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর বাইরে আমার কিছু মনে নেই। আমি ওই ফাইলগুলো বের করতে চাই না। ওগুলো দেখলে আমার বুকের মধ্যে অনেক কষ্ট বেড়ে যায়।
এ বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাসলিমা আক্তার। রশ্নি গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেন।