বাসস
  ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৫

শহিদ মাছুমকে হারিয়ে আজ বড়ো অসহায় তার পরিবার

প্রতিবেদন : দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ

কুমিল্লা, ১৫ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : ‘আমার আদরের নাতিটারে পাইল্লা সিয়ান (বড়) করছি, হাসিনা (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) তারে উঠাইয়া নিয়া গেল। বহু কষ্ট করে বড় করছি। আয় রোজগার করে পরিবারের হাল ধরবে। ছোট ভাই বোনদের মানুষ করবে। সে সুযোগ তাকে দেয়া হলো না।’ কান্না জড়িত কন্ঠে এ কথাগুলো বলছিলেন কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকায় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শহিদ মাছুম মিয়ার দাদা আয়েত আলী। প্রতিদিন সকাল বিকাল আদরের নাতি মাছুম মিয়ার কবরের পাশে আসেন তিনি। জীবদ্দশায় নাতির হত্যাকারীদের বিচার দেখে মরতে চান ।

কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার উত্তর রামপুর এলাকার মোঃ শাহিন মিয়ার ছেলে মাছুম মিয়া (২০)। তার বাবা শাহিন মিয়া একজন ট্রাক চালক। পরিবারের অভাব অনটনের কারনে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে খ-কালিন চাকুরি করতেন একটি রেস্টুরেন্টে। দু’ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। চাকুরি করে যা পেতেন ভাই বোনদের লেখাপড়া ও পরিবারের পেছনে ব্যয় করতেন।

গত ৪ আগষ্ট ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকায় ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সন্ত্রসীরা তাকে গুলি করে ও কুপিয়ে আহত করে। পরে শিক্ষার্থীরা তাকে উদ্ধার করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। সে সময়ে পরিচয় না পাওয়ায় বেয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফন করা হয়।

শহিদ মাছুম মিয়ার মা হোসনে আরা বেগম জানান, ৪ আগষ্ট সকালে প্যান্ট শার্ট পরে তৈরি হয় সে। নাস্তা করে যেতে বলায় দেরি হয়ে যাবে বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এদিন রাতে আর বাসায় ফেরেনি ছেলে। আমরা তার কর্মস্থলে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম সে কাজেও যায়নি। তিনদিন পর জানলাম আন্দোলনে গিয়ে নিহত হয়েছে। আমার ছেলের বুকের দু’পাশে গুলি করা হয়েছে। কান কেটে ফেলা হয়েছে, মাথাসহ সারা শরীরে কোপের দাগ। আমার ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। আমি এর বিচার চাই।

শহিদ মাছুম মিয়ার বাবা মোঃ শাহিন মিয়া বাসসকে বলেন, ৪ আগষ্ট থেকে আমার ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তিনদিন পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পেলাম বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আহত হওয়া আমার ছেলের ছবি। পরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগাযোগ করলে তারা সন্ধান দেয়নি। অনেক চেষ্টা করে জানতে পারলাম, তাকে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। পরে আদালত ও জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে লাশ উদ্ধার করে নিজ গ্রামে এনে দাফন করি।

স্থানীয় বাসিন্দা এম ফিরোজ মিয়া, মোস্তফা কামালসহ অনেকে জানান, মাসুম এলাকায় ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত। তাদের পরিবার বড় হওয়ায় তাঁর অসহায় ট্রাক চালক পিতার পক্ষে পরিবার চালাতে কষ্ট হতো, তাই মাছুম লেখাপড়া ছেড়ে একটি হোটেলে কাজ করতো। যা উপার্জন করত তা পরিবারকে দিতো। উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে পরিবারটি আরো অসহায় হয়ে পড়েছে।

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোঃ সিদ্দিকুর রহমান জানান, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে প্রতিহতের নামে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে। তারাই মাছুমের হত্যাকারী। মাছুম যুবদলের কর্মী বলে দাবি করেন তিনি।

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবাইয়া খানম বাসসকে বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এ উপজেলায় দু’জন শহিদ হয়েছেন। এর মধ্যে শহিদ মাছুম মিয়ার পরিবারটি খুবই অসচ্ছল ও অসহায়। তার উপার্জনের ওপর পরিবারটি অনেকটা নির্ভরশীল ছিল বলে জেনেছি। আমি ও জেলা প্রশাসক স্যার এ পরিবারটির কাছে গিয়েছি। খোঁজ খবর রাখছি। পরিবারটিকে সহায়তার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তালিকা পাঠিয়েছি। সরকার থেকে সহায়তা এলে পরিবারটিকে দেওয়া হবে।

এদিকে মাছুম মিয়ার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কুমিল্লা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও তাঁর মেয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তাহসীন বাহার সূচনাসহ ৬২ জনের নামে এবং আরও অন্তত ৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত ১৮ আগষ্ট রোববার রাতে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানায় এই হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।

শহিদ মাসুমের চাচা কুমিল্লার দিশাবন্দ এলাকার মৃত তাজুল ইসলামের ছেলে আবদুল হান্নান বাদী হয়ে এ হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামিদের সবাই সাবেক সংসদ সদস্য বাহারের ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর নিয়ন্ত্রিত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মী।