বাসস
  ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:৪৭

পুত্রের শেষ চুম্বন আর আলিঙ্গনের স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছেন শহিদ ইফাতের শোকাতুর মা

প্রতিবেদন : সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন

ঢাকা, ১৭ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ ইফাতের মা আজো প্রিয় পুত্রের শেষ মুহুর্তের আবেগময় স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছেন।

ইফাত হাসানের মা কামরুন নাহার পুত্রের সাথে তার হৃদয় বিদীর্ণ করা শেষ মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি আমার ছেলের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো অনুভব করতে পারি... আমার ছেলে শেষবারের মতো চলে যাওয়ার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলো, যা আমি সারাক্ষণ অনুভব করি।’  
ইফাতের মা কামরুন নাহার ২০ জুলাই ছেলেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যাওয়া থেকে বিরত করতে চেয়েছিলেন। ইফাত বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তিনি ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন যাতে ছেলে বাইরে না যায়। কিন্তু ইফাত নিজেও মাকে জড়িয়ে ধরেন। উদ্বিগ্ন মাকে রাজি করাতে মায়ের কপালে দু’বার চুম্বন করেন।

ইফাতের শোকাহত মা সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন,  দুপুর সাড়ে ১২টায় বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগ মুহূর্তে ইফাত বলেছিলো, ‘তুমি আসলে আমাকে অনেক ভালোবাসো তাই তোমার এমন মনে হচ্ছে। চিন্তা করো না মা, আমি খুব বেশি দূরে যাব না, আমি শিগগিরই ফিরে আসব’।

যাত্রাবাড়ির দনিয়া এলাকার এ কে স্কুল এ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র ১৬ বছর বয়সী ইফাত সেদিন বিকেলেই বাড়ি ফিরেছিলো, কিন্তু লাশ হয়ে। সেদিন যাত্রাবাড়ির শনির আখড়া এলাকায় পুলিশের গুলি বুকে বিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, শনির আখড়া এলাকায় আহত এক ব্যক্তিকে পার্শ্ববর্তী সালমান হাসপাতালে ভর্তি করাতে গিয়েছিলেন ইফাত। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার সময় পুলিশ তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে।

‘আমার সুস্থ ছেলেটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় আমার কপালে দুটো চুমু দিয়ে গেল। কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি, এটিই তার শেষ বিদায় হবে... আমি আমার কপালে তার চুম্বনের শেষ স্পর্শটুকু ভুলতে পারি না! আমি যখন জেগে থাকি তখন এই ছবিটিই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে’ কামরুন নাহার ছেলের সাথে তার শেষ স্মৃতিটুকু স্মরণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

সম্প্রতি যাত্রাবাড়ির কাজলা এলাকার রসুলপুরে তাদের ভাড়া বাসায় বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কামরুন বলেন, ‘আন্দোলনের শুরু থেকেই ইফাত ছাত্র আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্ম ছিলেন। ১৮ ও ১৯ জুলাইয়েও তিনি আন্দোলনে যোগ দেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘ইফাত যখনই বাইরে যেতো তখনই আমি আয়াতুল কুরসি (পবিত্র কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত) পড়ে তার মাথায় ফুঁ দিতাম। শুক্রবার সে যখন আন্দোলনে যাচ্ছিল তখনও আমি তার মাথায় ফুঁ দিয়েছিলাম।’

কামরুন নাহারের তিন সন্তানের মধ্যে ইফাতই একমাত্র ছেলে। তার বড় মেয়ে উম্মে সালমা ইফতি বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়েন। আর ছোট মেয়ে তাজরিয়া আলিমা (৫) এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি।

তার ব্যাংকার স্বামী রবিউল আমিন খন্দকার ২০২২ সালে মাত্র ৫০ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পুত্র ইফাতই মায়ের জীবনের একমাত্র অবলম্বন ছিলো।

মৃত্যুর আগের দিন ১৯ জুলাই,  শুক্রবার সন্ধ্যায় আন্দোলন থেকে বাসায় ফেরার পর ইফাত তার মায়ের কাছে রাস্তার পরিস্থিতি বর্ণনা করে বলেন, ওই দিন তার সামনে দুইটি ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

কামরুন নাহার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, সে সময় আমি তাকে  অনুনয় করে বলেছিলাম, ‘তুমি আমার লক্ষ্মী   সোনা বাচ্চা, তুমি আর বাইরে যেও না। তুমি ছাড়া যে আমার কিছু নেই।’ কিন্তু তবুও আমি তাকে আন্দোলনে যাওয়া থেকে বিরত করতে পারিনি।

তিনি আরো জানান, ইফাত কখনই তাকে না জানিয়ে বাড়ির বাইরে যাননি। কারণ তিনি জানতেন যে তার বাবার মৃত্যুর পর থেকে যখনই তিনি মায়ের চোখের আড়াল হন তখনই তার মা অস্থির হয়ে পড়েন।

তিনি যখন তাকে আন্দোলনে যোগ দিতে বাধা দিতেন, তখন ইফাত তাকে বলতেন,  ‘দেশ যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তার অবসান ঘটাতে অনেক বাবা-মায়ের সন্তানই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে’।

ইফাত বলতেন, ‘আমরা যদি সবাই ঘরে বসে থাকি, তাহলে আন্দোলন সফল হবে না, বরং দেশ অচল হয়ে পড়বে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ছাত্র এবং শিশুসহ অনেক লোককে হত্যা করছে।’

তিনি বলেন, ইফাত অবশ্য তাকে বলতেন যে তিনি পরের দিন থেকে আন্দোলনে যাবেন না, কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পরের দিনটি আর তাদের জীবনে আসেনি।
সন্তানদের পড়ালেখা ও ভরণ- পোষণ চালিয়ে নিতে তার সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে কামরুন নাহার বলেন, ইফাতের চাচা ও মামাসহ আত্মীয়-স্বজনরা তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ইফাত ছিল আমার একমাত্র ছেলে। তাকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। তারা কিভাবে আমার নিষ্পাপ ছেলের বুকে গুলি চালাতে পারলো?’

২০ জুলাই ইফাত বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মন খুব অস্থির ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দুপুর ২টা বা আড়াইটার দিকে, আমি দুটি গুলির শব্দ শুনে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম এবং আমার বড় মেয়েকে বলেছিলাম, গুলিটা মনে হয় আমার বুকে এসে লাগলো।’

তারপরই তিনি তার মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘ইফাত কোথায়? সে এখনো ফেরে না কেন?’

ইফাতের মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘যখন আমি ইফাতের কথা ভেবে উদভ্রান্তের মতো এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাচ্ছিলাম, তখন আমাদের আগের ভাড়া বাড়ির মালিক ফোনে আমার মেয়েকে জানায় যে ইফাতকে পুলিশ গুলি করেছে এবং তাকে সালমান হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

সে সময় তার বড় মেয়ে উম্মে সালমা তাকে জানান, ইফাতের পায়ে সামান্য আঘাত লেগে থাকতে পারে।

কামরুন নাহার অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা নিচে নামার আগেই দেখলাম ইফাতের বন্ধুরা তাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসছে।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ ইফাতের লাশ ছিনিয়ে নিতে চাইলে তার সহযোদ্ধারা বাধা দিয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

সালমান হাসপাতালের ব্যবস্থাপক সুরভি সোহানা বাসসকে বলেন, ইফাতকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু যেহেতু কেউ তার পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি, তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইফাতের একটি ছবি তুলে বিক্ষোভকারীদের কাছে পাঠায়। তিনি বলেন, তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর বিক্ষোভাকারীদের সহায়তায় তার লাশটি বাড়ি পাঠানো হয়।

সালমান হাসপাতালটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন শনির আখড়া বাস স্টপেজের কাছে অবস্থিত। ১৬ জুলাই  মো. আবু সাঈদসহ আরো ৬ জন বিক্ষোভকারী শহিদ হওয়ার পর ১৭ জুলাই থেকে এলাকাটি রীতিমতো একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়।

আন্দোলনের সময় সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে হাসপাতালের সামনের রাস্তায় বিশৃঙ্খলার কোনো প্রমাণ তাদের কাছে আছে কি না জানতে চাইলে সোহানা বলেন, বিক্ষোভ চলাকালে যাত্রাবাড়ি থানার পুলিশ হাসপাতালের সিসিটিভি ক্যামেরার হার্ডডিস্ক জব্দ করে নিয়ে গেছে। এছাড়া আন্দোলনকারীদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ায় পুলিশ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও হয়রানি করেছে।

তিনি বলেন, ‘বিক্ষোভের সময় প্রায় ১৫ থেকে ২০ টি মৃতদেহ তাদের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে  আনা হয়। তবে আহতের সংখ্যা ছিল অগণিত।’

ইফাতের মা বলেন, ইফাতের নিষ্পাপ লাশ হাসপাতালে পড়ে থাকতে দেখে চিকিৎসকরা তার প্রতি সহানুভূতিশীল হন। তারা পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে হাসপাতাল সংলগ্ন একটি সরু গলি দিয়ে তার লাশ বের করে দেন।

ক্রন্দনরত মা কামরুন নাহার আরো বলেন, ‘আমি সৌভাগ্যবান যে সর্বশক্তিমান আল্লাহর রহমতে, আমি আমার প্রিয় সন্তানের মরদেহ দেখতে পেয়েছি,  যখন অনেক লোক তাদের কাছের এবং প্রিয়জনের লাশ খুঁজে পায়নি।’

এজন্য তিনি সালমান হাসপাতালের ডাক্তারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

আবেগাপ্লুত কন্ঠে তিনি বলেন, ‘তবে, আমি এখনও আমার মনকে বোঝাতে পারি না। আমার কেবলই মনে হয়, আমি নিজে কেন তার পিছনে পিছনে যাইনি? আমি যদি তার সাথে সাথে থাকতাম তবে সে হয়তো রাস্তায় যেত না।’

তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই ইফাতের স্বপ্ন ছিলো বড় প্রকৌশলী হওয়ার।  সে অত্যন্ত মেধাবী ও পড়ালেখায় মনোযোগী ছিলো। আর তার শখ ছিলো ক্রিকেট খেলা।

২০ জুলাই রাতেই ইফাতকে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার মনপুরা গ্রামে তাদের গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়।

একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে গভীর শোকে আকুল ইফাতের মা পুত্র হত্যার বিচার চান।

তিনি বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হলে আমি অন্তত একটু শান্তি পাবো।’