শিরোনাম
প্রতিবেদন : দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ
কুমিল্লা, ২০ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : সামনে পরীক্ষা। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে মেঘকে। কিন্তু মেঘ বেশি সময় বসতে পারেন না। তাই বলতে গেলে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ালেখা করছেন তিনি। পরীক্ষাও দিতে হবে তাকে দাঁড়িয়েই।
সারাফ সামির জামান মেঘ (১৬) কুমিল্লা ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের এসএসসি পরীক্ষার্থী। কদিন বাদেই পরীক্ষা। অথচ মেঘ ৫/৭ মিনিটের বেশি সময় বসে থাকতে পারেন না। কারণ তার শরীরের পেছনের অংশের কোমরে এখনো রয়ে গেছে ৩১৯টি ছররা গুলি। শরীরে বয়ে বেড়ানো এসব গুলির কারণে চরম যন্ত্রণা ভোগ করছেন মেঘ। তার জীবনটা এখন দুর্বিষহ। পারছেন না ঠিক মতো ঘুমাতে কিংবা বসতে। করতে পারছেন না চলাফেরাসহ স্বাভাবিক কাজকর্ম।
জানা গেছে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমপ্লিট শাটডাউনের প্রথম দিন গত ১৮ জুলাই পরিবারের সদস্যদের না জানিয়ে মেঘ সকাল ১০টায় বাসা থেকে বের হয়।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সাথে সে আন্দোলনে যোগ দেয়। তখন আন্দোলনকারীরা ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকায় অবস্থান নেয়। সেখানে ছাত্রদের একটি সমাবেশ হয়। পরে এ সমাবেশে পুলিশ হামলা করে। তখন শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে পুলিশের বিশেষ ফোর্স এসে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। এ সময় মেঘ দু’হাত তুলে পুলিশের কাছে আত্মসমপর্ণ করেও রক্ষা পায়নি। পুলিশ তাকে প্রথমে পিটিয়ে ও পরে গুলি করে ফেলে রেখে যায়। সে সময়ে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে সড়ক দিয়ে যাওয়া একটি অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দেয়। তখন তাকে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে আনা হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। এরপর চিকিৎসা নেন কুমিল্লা সেনানিবাসের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। বর্তমানে সে কুমিল্লা সিএমএইচের ডাক্তার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল রেজওয়ানুল হকের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রথম যাত্রায় মেঘ বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে প্রায় দু’মাস চিকিৎসা নিয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও এখনও সুস্থ জীবনে ফিরতে পারেন নি।
সারাফ সামির জামান মেঘের বাবা আরাফাত জামান (৪৫) একজন ব্যবসায়ী। মা কামরুন নাহার শীলা (৪৩) কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
মেঘের গ্রামের বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার পূর্ব উকিল পাড়া হলেও ছেলের লেখাপড়া ও নিজের চাকুরীর সুবাদে কামরুন নাহার ছেলেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা সদর দক্ষিণ উপজেলার কোটবাড়ি এলাকায় খান বাড়িতে ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন।
মেঘের মা কামরুন নাহার শীলা বলেন, ‘গত ১৮ জুলাই সকালে আমার ছেলে মেঘ আমাকে না বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে কোটবাড়ি বিশ্বরোডে আন্দোলনে যায়। দুপুর একটায় আমি তাকে ফোন করে বাসায় আসার তাগাদা দেই। এর কিছুক্ষণ পরই আমার কাছে খবর আসে মেঘ নামে কুমিল্লা ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের এক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমি তখন আতংকিত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করেও সঠিক খবর পাচ্ছিলাম না। পরে অপরিচিত এক নম্বর থেকে কল দিয়ে বলে, আপনার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমরা তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তখন অজানা এক আশংকা চারপাশে ভিড় করতে শুরু করে। ছেলে জীবিত আছে কি না এ সংশয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। পরে তারা আবার কল করে জানায়, মেঘকে সদর হাসপাতালে রাখেনি। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে কুচাইতলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আমরা তাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি। পরে ভাবলাম হয়তো বেঁচে আছে। এদিকে বাসা থেকে বের হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথে বিভিন্ন বাহিনী ও আওয়ামী দলীয় কর্মীদের বাধার মুখে পড়তে হয়েছিলো। সেদিন কী উদ্বিগ্ন, কী কঠিন সময় যে পার করতে হয়েছিল তা বলে বুঝানোর মতো না ।
তিনি আরো বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমার ছেলে আত্নসমপর্ণ করেছিলো। তারপরও তাকে গুলি করা হয়েছে। পুলিশ খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে।’
চিকিৎসাধীন ডাক্তারের বরাত দিয়ে মা কামরুন নাহার শীলা বলেন, ‘মেঘের শরীরে এখনও ৩১৯টি ছররা গুলি আছে। শুনেছি এগুলো বের করা যাবে না। হয়তো মেঘকে এ গুলি গুলো সারা জীবন শরীরে বয়ে বেড়াতে হবে। সামনে মেঘের এসএসসি পরীক্ষা। সে ৫/৭ মিনিটের বেশি সময় এক নাগাড়ে বসতে পারে না। ব্যথা শুরু হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর পর শরীর ব্যথা করে, চুলকায়। শরীরে জ্বালাসহ নানা জটিলতার মধ্যে আছে সে। আমরা নিয়মিত সিএমএইচের ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ রাখছি। আমার একটি মাত্র সন্তান। ছেলের ভবিষ্যত কি হবে জানি না। ভীষণ অনিশ্চিয়তায় দিন পার করছি আমরা।’
সারাফ সামির জামান মেঘ বলেন, পুলিশ আমাকে পিটিয়ে মাটিতে ফেলে খুব কাছ থেকে গুলি করেছে। আমার শরীরে এখনও অনেক গুলি রয়েছে। এগুলো অনেক ব্যথা করে। আমি ৫/৭ মিনিটের বেশি সময় বসতে পারি না। বসলে ব্যথা আরো বেড়ে যায়। সামনে আমার এসএসসি পরীক্ষা। ঠিকমত পড়তে পারি না। দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। এছাড়া কয়েক দিন আগে স্কুলের নির্বাচনী পরীক্ষাও দিয়েছি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এক কাত হয়ে শুতে হয়। শরীরের গুলিগুলো মাঝে মাঝে মনে হয় নড়াচড়া শুরু করে। শরীর চুলকায়, প্রস্রাবে সমস্যা হচ্ছে। ঠিকমত চলাফেরা করতে পারি না। কী এক দুর্বিষহ অবস্থা আমার। কিন্তু আমি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে চাই।
কুমিল্লা ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক সাবেকুন নাহার বলেন, মেঘ এ প্রতিষ্ঠানের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সে আহত হয়েছে। তার শরীরে এখনও অনেক গুলি আছে। সামনে মেঘ এসএসসি পরীক্ষা দেবে। সে ক্লাসে বসতে পারে না ব্যথার কারণে। বিষয়টি বিবেচনা করে আমরা নির্বাচনীসহ বিভিন্ন পরীক্ষা ও ক্লাসে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করেছি। তার শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে প্রতিষ্ঠান প্রধানের পরামর্শে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা করা হবে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আবু মুহাম্মদ রায়হান বলেন, ১৮ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা যখন পুলিশ-ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের আক্রমণের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়, সেই মুহূর্তে মেঘের মতো স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ইস্পাত কঠিন দূর্গ গড়ে তোলে। মেঘরা ছিল আমাদের অনুপ্রেরণা। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কিভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়, শত শত মেঘেরা সেইদিন আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছিল।