শিরোনাম
\ শাহজাহান নবীন \
ঝিনাইদহ, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : পিচঢালা রাজপথে সেদিন ছিল বারুদের গন্ধ। কোথাও কোথাও ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। অজানা আতঙ্কের নগরী ছিল প্রিয় ঢাকা শহর। মানুষের মাঝে চাপা ভয়, কখন যেন কি হয়ে যায়। তারপরও সেদিন আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে বারবার স্লোগান ভেসে আসছিল সারাদেশ থেকে। যে স্লোগানের হুঙ্কার রাজধানীর অট্টালিকার দেয়ালে সৃষ্টি করেছিল বিপ্লবের প্রতিধ্বনি।
গণঅভ্যুত্থানের এমনই এক উত্তাল সময়ে গত ৫ আগস্ট বেলা ১১টায় ঢাকার যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভারের নিচে চলছিল ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ-র্যাব নির্বিচারে গুলি চালায়। বহু মানুষ গুলিবিদ্ধ হন। মারা যায় অসংখ্য। সেই বিক্ষোভে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েও প্রাণে বেঁচে যান গাড়িচালক মেহেদি হাসান পাপ্পু (২৫)।
ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার ৯ নং পোড়াহাটি ইউনিয়নের রুপদিয়া গ্রামের বাসিন্দা মতিউর রহমান (৫৫) ও জেসমিন আক্তার (৪২) দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান মেহেদি হাসান পাপ্পু।। মেহেদি হাসানের বড় বোন সাথী খাতুন (৩০) বিবাহিত। একমাত্র ভাই পাভেল হাসান (২০) একটি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। গ্রামের বাড়িতে বাবা-মা, ভাই, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মেহেদির সুখের সংসার। মেহেদি হাসানের স্ত্রী সমাপ্তি খাতুন (২০) সদর উপজেলার হরিশংকরপুর ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামের বাসিন্দা আমিরুল বিশ্বাসের কন্যা। মেহেদি-সমাপ্তি দম্পতির একমাত্র পুত্র মাহিদ হাসান পাঁচ মাসের শিশু।
মেহেদি হাসান ঢাকার কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়ায় ইনসাইট ইলেকট্রিক কোম্পানিতে গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত। দুই বছর ধরে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। চাকরির সুবাদে মেহেদি হাসান ঢাকায় বসবাস করেন। গত ৫ আগস্ট সকালে যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভারের নিচে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেন মেহেদি। ওই সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। মাথায় গুলি লাগার পর মেহেদিকে স্থানীয় ডেল্টা হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে তিনি বসুন্ধরায় আদ দ্বীন হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা নেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়া প্রসঙ্গে মেহেদি হাসান বাসস’কে বলেন,‘নিজের স্বার্থের জন্য আন্দোলনে যাইনি। আমার মনে হয়েছিল,দেশটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।ছাত্ররা রাস্তায় নেমে গুলিতে মারা যাচ্ছে।তাই একজন অত্যাচারী শাসকের পতনের জন্য, দেশের জন্য, মানুষের জন্য বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেই।’
মাথায় গুলি লাগার পর থেকে শারীরিক নানা সমস্যার কথা জানিয়ে মেহেদি হাসান বলেন, ‘এখন মাঝে মাঝে মাথা শীতল হয়ে যায়। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগে। কোনো কিছুই বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে কাউকে চিনতে পারি না। নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। তারপরও রাতে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলে ঘুমাতে পারি না। গাড়ি না চালালে আমার সংসার চলে না। স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মায়ের কথা ভেবে গাড়ি চালাতে হয়।’
অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে মেহেদি হাসানের বাবা মতিউর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলের মাথায় গুলি লাগার পর তার এক বন্ধু আমাকে ফোন করে প্রথম খবরটি জানায়। আমি ওই বন্ধুর নাম ঠিকানা জানি না। ভেবেছিলাম, ছেলেটা হয়তো মারাই গেছে! কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমার বাজান প্রাণে বেঁচে আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আন্দোলনের ওই সময়টাতে খুব ভয়ে থাকতাম। মনে হতো, এই বুঝি পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে। মাথায় গুলি লাগার পর ঢাকায় চিকিৎসা নিয়ে ৭ আগস্ট মেহেদি বাড়িতে চলে আসে। মাথার যন্ত্রণায় এখনো মাঝে মাঝে সে রাতে ঘুমাতে পারে না।’
চোখ মুছতে মুছতে মেহেদির মা জেসমিন আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলেকে আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু নেই। আমার খোকা ঢাকায় কত কষ্ট করে গাড়ি চালিয়ে সংসারে টাকা পাঠায়। আমার ছেলেটা এখন প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার একটা পাঁচ মাস বয়সী ছেলে আছে। মেহেদির কিছু হয়ে গেলে, সংসারটাই শেষ হয়ে যাবে।’
নিজ কর্মস্থলের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তার (সিইও) প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মেহেদি বলেন, ‘আমার কোম্পানির সিইও স্যার অত্যন্ত ভালো মানুষ। আমি আন্দোলনে গিয়ে আহত হওয়ার পর কোম্পানি থেকে প্রায় লক্ষাধিক টাকা আমার চিকিৎসার পেছনে ব্যয় করেছেন। আমার বস, আমার খোঁজ খবর নেন। সবসময় তিনি আমাকে সহযোগিতা করেন।’
মেহেদির কর্মস্থল ইনসাইট ইলেকট্রিক কোম্পানির মালিক শফিকুর রহমান বাসস’কে বলেন, ‘আমার এখানে কর্মরত যে কেউ অসুস্থ হলে আমরা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে থাকি।মেহেদি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়।আমরা সাধ্য অনুযায়ী তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি।
ব্রেনে আঘাত পাওয়ায় মেহেদি কিছু জটিলতায় ভুগছে। চিকিৎসকের সাথে এ নিয়ে আমি কথা বলেছি।সরকার উদ্যোগ নিলে মেহেদির উন্নত চিকিৎসা সম্ভব।’
ছেলের জন্য দোয়া চেয়ে মেহেদি হাসানের মা জেসমিন আক্তার আরও বলেন, ‘আগের (আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন) সরকার যা করেছে, তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমার ছেলে আজ আহত। তারপরও এটুকু স্বস্তি একটা জুলুমকারী সরকারের পতন হয়েছে। আমার ছেলেটার জন্য গর্ব হয়। কত মায়ের বুক খালি হয়েছে। কত মায়ের সন্তান পঙ্গু হয়েছে। আমি সবার জন্য দোয়া করি।’
গত ৫ আগস্টের দুঃসহ স্মৃতির কথা উল্লেখ করে মেহেদি বলেন, ‘যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভারের নিচে আমরা যাওয়ার পরই এলোপাতাড়ি গুলি ধেয়ে আসে। ওই সময় আমার পাশে থাকা একজন মাথায় গুলি লেগে সেখানেই মারা যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি গুলি এসে আমার মাথায় লাগে। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। পরে যখন জ্ঞান ফেরে, তখন দেখি আমি হাসপাতালে।’
দেশে যেন আর কখনো কোনো সরকার ‘ফ্যাসিস্ট’ হয়ে উঠতে না পারে সেই কামনা করে মেহেদি হাসান পাপ্পু বাসস’কে বলেন, ‘ছাত্র-জনতা জীবন দিয়ে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটিয়েছে। তাই চাই, সকলের অধিকার নিশ্চিত হোক। দেশের মানুষ নিরাপদ একটি দেশ চায়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের পাশে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকবে, এই প্রত্যাশা করি।’