শিরোনাম
প্রতিবেদন : বরুন কুমার দাস
ঢাকা, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : পাসপোর্ট করা হয়েছে। কাগজপত্রও প্রায় প্রস্তত। উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য জাপান যাওয়ার কথা ছিল শোভনের। কিন্তু তার আর জাপান যাওয়া হলো না। ছেলেটার ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া শেষে চাকরি করে পরিবারের অভাব-অনটন দূর করার। তার আগেই শোভনকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হলো।
রাজধানীর কামরাঙ্গীচরের বড়গ্রাম ছোট মসজিদ এলাকার ৩ নং রোডের ভাড়া বাসায় বাসস’র সাথে আলাপকালে এসব কথা জানালেন শোভনের মা শাহনাজ বেগম (৪০)। গত ১৯ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন কলেজ ছাত্র শহিদুল ইসলাম শোভন (১৯)।
শাহনাজ বেগম বলেন, ‘সেদিন ছিল ১৯ জুলাই শুক্রবার। শোভন দুপুরে জুমার নামাজ পড়ে এসে বিরিয়ানি খাচ্ছিল। ওর বন্ধুরা তখন বার বার ফোন দিচ্ছিল সবাই মিলে আন্দোলনে যাবে। ছেলেটা আমার তাড়াহুড়া করে খেয়ে চলে গেলো। আমি কি জানতাম ওটাই আমার ছেলের শেষ খাওয়া, এটাই তার সাথে আমার শেষ দেখা ও কথা?’
শহিদুল ইসলাম শোভন গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার দিকে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত হন। ২০ জুলাই শনিবার বিকেলে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় হাফিজি হুজুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। ২০০৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণকারী শোভন এ বছর শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
শোভনের মা অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলেন, ‘কত স্বপ্ন ছিলো ছেলেটাকে নিয়ে, সব শেষ হয়ে গেলো। আমার সাজানো- গোছানো সংসারটা শেষ হয়ে গেলো। জানি না বাকি জীবনটা কিভাবে কাটবে আমাদের। সরকারের কাছে আমাদের কিছু চাওয়ার নাই। শোভন দেশের জন্য যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে মারা গেছে, শোভন যেমন দেশ চেয়েছিল সেরকম হোক এই দেশটা। দেশের মানুষ যেন আমার সন্তানকে মনে রাখে, ওর আত্মত্যাগের কথা ভুলে না যায়।’
শহিদ শোভনের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার উত্তর খোলাপাড়া গ্রামে। বাবা নজরুল ইসলাম (৪৬) একজন ছোট ব্যবসায়ী। তবে ছেলে নিহত হওয়ার পর থেকে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ব্যবসা বন্ধ রেখেছেন। শোভনের ছোট বোন নাদিয়া ইসলাম নেহা (১৪) স্থানীয় আশরোফা হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী।
শহিদ শোভনের কামরাঙ্গীচরের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, টেবিলের সামনের দেয়ালে বড় করে লেখা রয়েছে ‘আঁধারে নয়, আলোতে ভয়’। বইপত্র টেবিলে তেমনি সাজানো রয়েছে। বড় একটা টিভি রয়েছে। জামা কাপড় আলমিরাতে সাজানো। পরিবারের সদস্যদের সাথে ছবি টানানো।
শোভনের মা এসব দেখিয়ে বলেন, দেখেন ভাই আগে ছবিতে আমাদের পরিবারের চারজন সদস্য ছিল। এখন আর শোভন নেই। এই ছবি শুধু স্মৃতি। বই আছে পড়ার জন্য, কিন্তু আমার শোভন নেই। জানুয়ারি মাসে টিভি কিনে দেই। এখন এই টিভি দেখবে কে? দেখেন ভাই ওই যে ওর জামা গুলো সাজানো রয়েছে, ওর বোন জামাগুলো দেখেই কান্না শুরু করে আর বলে ভাইয়া তুমি কি আর ফিরে আসবে না? এই সব কথা শুনলে মায়ের মন কেমন লাগে। কিভাবে জীবন পার করবো আমরা?
শোভনের বাবা নজরুল ইসলাম বলেন, গত ১৯ জুলাই বিক্ষোভরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে ঢাকা নিউমার্কেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন সাইদুল ইসলাম শোভন। পড়াশোনার জন্য তার জাপানে যাওয়ার কথা ছিল। কাগজপত্রও প্রায় প্রস্তত করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আর যাওয়া হলো না তার। তার আগেই মালিকের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলো ওপারে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে শোভনের বাবা জানান, আসলে আমরা সে সময়ে ওখানে ছিলাম না, যাদের সাথে আন্দোলনে গিয়েছিল, আন্দোলন চলাকালে কে কোথায় গেছে ঠিক ছিল না। ওর বন্ধুরাও বলতে পারে না। আলমগীর হোসেন নামে এক ছেলে শোভনকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। সে জানিয়েছে, ‘আমরা তখন নিউমার্কেট পেট্রোল পাম্পের সামনে। ধাওয়া-পালটা ধাওয়া চলছে। গুলির শব্দ হচ্ছে মুহুর্মুহু। পুলিশ যখন অনেক দূরে চলে গেছে তখন পেছনে তাকিয়ে দেখি একটা ছেলে সেজদার ভঙ্গিতে বসে আছে। ততক্ষণে আমাদের ছাড়িয়ে পুলিশ আরো সামনের দিকে চলে গেছে। দৌড়ে গেলাম ছেলেটার কাছে। দেখি ওর প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ওর পেটের নিচের অংশে গুলি লেগেছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাই, আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যাবেন, প্লিজ।’ একথা বলতে না বলতেই আমার গায়ে শরীর এলিয়ে দিলো। আমরা দ্রুত একটা রিকশা নিলাম। তখনো বেঁচে ছিল ছেলেটা।
আলমগীরের বরাত দিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ওর আঙুল দিয়ে ওর ফোন আনলক করে বাসায় ওর মার কাছে ফোন করে জানায় শোভনের গুলি লেগেছে। ওকে আমরা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে দেখি ওখানে আহত-নিহত মানুষের ছড়াছড়ি। চারদিকে কান্নাকাটি আর হুড়োহুড়ি। একজন ডাক্তার পালস দেখে বললেন, ‘ও অনেক আগেই মারা গেছে।’
শোভনের মা বলেন, খবর শুনে পাগলের মত ছুটে গেলাম হাসপাতালে। দেখলাম জরুরি বিভাগের এক পাশে একটা ট্রলিতে আমার ছেলেটা পড়ে আছে। কয়েকটা ছেলে ওর পাশে দাঁড়ানো। শোভনের কাছে দৌড়ে গেলাম। আমার ছেলের দেহ নিথর। কত্ত ঝাঁকুনি দিলাম, কতবার ডাকলাম, ছেলে কিছু বলে না। একটা কথাও বললো না।
তিনি বলেন, ছেলে আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে মারা যাওয়ায় ভয় হচ্ছিল, যদি পুলিশ লাশ নিয়ে যায়। যদি আমাদেরকে এ্যারেস্ট করে! তাই ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাড়াহুড়া করে আমার ভাইদের আর ওর বন্ধুদের সহয়তায় কোনোমতে জোর করেই হাসপাতাল থেকে ছেলেকে নিয়ে আসলাম।
ছেলের স্মৃতিচারণ করে শোভনের মা বলেন, কয়েক বছর আগের এক ২১ শে ফেব্রুয়ারি। শোভন তখন ক্লাস সেভেনে বা এইটে পড়ে। সেইদিন শোভন একটা পোস্টার বানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলো। ওই পোস্টারটিতে ছিল পাঁচজন ভাষা শহিদ: সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বার-এর ছবি, শহিদ মিনারের আঁকা একটা ছবি আর ছিলো শোভনের নিজের ছবি। সময়ের পরিক্রমায় সেই পোস্টারের সব চরিত্র আজ এক, তারা সবাই শহিদ। দেশের জন্য সবাই রাজপথে জীবন দিয়েছে। সৃষ্টিকর্তা শোভনের শাহাদাত নির্ধারিত করে রেখেছিলেন বলেই কি ওই পোস্টারের সব চরিত্র এক হয়ে গেল!
কাঁদতে কাঁদতে তিনি আরও বলেন, আমরা তো জানতাম না আমার ছেলের দেশের প্রতি এই রকম ভালোবাসা ছিল। ও যে নিজেই দেশের জন্য পোস্টারের আরেকজন শহিদ হয়ে গেল! শোভন মারা যাওয়ার পরে ওরে ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমরা এই পোস্টারটি দেখি, তবে কি শোভন এমনভাবেই শহিদ হতে চেয়েছিল কিংবা সৃষ্টিকর্তা শোভনের ভাগ্যে আগেই শাহাদাত লিখে রেখেছিল?
শোভনের নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে সরকারের প্রতি দাবি রেখে মা শাহাজান বেগম বলেন, যেখানেই হোক (ঢাকা অথবা মুন্সিগঞ্জ) ওর নামে যেন একটা মসজিদ নির্মাণ করা হয়। যেখানে সবাই নামাজ পড়ে আমরা ছেলে সহ সকল শহিদের জন্য দোয়া করবে।
নিহতদের শহিদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, যারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের সবাইকে শহিদের মর্যাদা দিতে হবে। শুধু মুখে মুখে শহিদ বললেই হবে না। এদেরকে রাষ্ট্রীয় ভাবে শহিদের মর্যাদা দিতে হবে। এরাতো দেশের জন্যই জীবন দিয়েছে।
বোরহানউদ্দিন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন বলেন, শোভন খুব সাহসী ছিল। সে আমাদের জাতীয় বীর। শোভনের মত তরুণদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই এই দেশের নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। আমরা এই জাতীয় বীরদের অবদান ভুলব না। শোভনের স্মরণে চানখার পুল চত্বরকে ‘শোভন চত্বর’ নামকরণ করা হয়েছে। শোভন সবার জন্য এক অনুকরণীয় চরিত্র।