শিরোনাম
প্রতিবেদন : ইসমাঈল আহসান
ঢাকা, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : পিঠের নিচের অংশ দিয়ে গুলি ঢুকে পেট দিয়ে বের হয়ে গেছে। তারপরও বিস্ময়করভাবে বেঁচে আছেন কিশোর ইখতিয়ার উদ্দীন সরকার। পনেরা বছরের তারুণ্যদীপ্ত ছেলেটি এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। উত্তরার নওয়াব হাবীবুল্লাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করেন তিনি । গুলিতে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে যে ঠিকমতো হাঁটতে পারেননা, তিনি কিভাবে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন তা নিয়ে পরিবারে চলছে চরম দুশ্চিন্তা। শত দুঃখের মাঝে তারপরও সান্ত্বনা যে, তাদের আদরের ধন প্রাণে বেঁচে আছেন। কিন্তু ইখতিয়ারের সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। অসুস্থ শরীর নিয়েই তিনি দিনরাত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসস’র এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপ হয় ইখতিয়ারের বাসায়। তখন আমরা প্রথমে পড়ার টেবিলে তাকে পড়তে দেখে বুঝতেই পারিনি যে, তিনি এতটা আহত। তারপর আলাপের এক পর্যায়ে তিনি যখন তার কাপড় উঁচিয়ে দেখালো, রীতিমতো হতবাক হয়ে গেলাম। পেট এবং পিঠের নীচের দিকে বড় দু‘টি গর্ত। একটা দিয়ে গুলি ঢুকেছে এবং অপরটা দিয়ে বের হয়ে গেছে। পেট থেকে বুক অবধি অপারেশনের সেলাইয়ের লম্বা ক্ষত।
আমরা অবাক হবোই বা না কেন? কারণ তার কন্ঠে কোন জড়তা নেই। এইরকম শারীরিক অবস্থা যার, তার কন্ঠ বা বডি ল্যাংগুয়েজে সেটা বোঝা বড় দায়। দৃপ্ত কন্ঠে সাক্ষাৎকারের পুরোটা সময় আমাদের সাথে কথা বললো তিনি। কতটা টগবগে কিশোর হলে এটা সম্ভব?
তার বাবা বললেন, গতকালকেও সে একা হাঁটতে গিয়েছিল। হঠাৎ পড়ে যেয়ে হাত-পা ছিলে গেছে। হাতের ছিলা অংশে ব্যান্ডেজ পরা দেখলাম। কিন্তু তারুণ্যদীপ্ত ছেলেটি এটা মানতেই নারাজ। কেমন যেন পারলে এখনই ফুটবল খেলতে চলে যায়।
সেদিন ছিল ৫ আগস্ট, বিকেল চারটা। দ্বিতীয় স্বাধীনতার আনন্দে মাতোয়ারা পুরো বাংলাদেশ। ব্যতিক্রম ছিল না উত্তরাও। আনন্দে রাস্তায় নেমে আসে লক্ষ জনতা। ইখতিয়ার এবং তার বন্ধুরা ছিল দক্ষিণখানের কাঁচা বাজার এলাকায়। তারা দুপুরের দিকে শোনে যে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। তখনই তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে উঠে আনন্দ করতে করতে সামনে এগুতে থাকে। এর মধ্যে হঠাৎ কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই উত্তরা পূর্ব থানা, র্যাব-১ ও এবিপিএন সদর দপ্তর থেকে মুহুর্মুহু গুলি বৃষ্টি হতে থাকে। হতচকিত মানুষ যে যে দিকে পারে পালাতে থাকেন। অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। কেউ আহত, কেউ বা শহিদ হন। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন রোড ফ্লাইওভারের উপর থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে একদল পুলিশ দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ বিমান বন্দরের দিকে আসতে থাকে। ইখতিয়াররা তখন ছিল ফ্লাইওভারের গোড়ায়। হঠাৎ তার পিছন দিক থেকে একটা গুলি পিঠ দিয়ে ঢুকে পেট দিয়ে বের হয়ে যায়। প্রথমে সে বুঝতেই পারেনি যে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। রক্ত দেখে সাথে সাথে তার বন্ধুরা অনেক কষ্টে উত্তরার বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে প্রায় দুই ঘন্টা বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকতে হয় ইখতিায়রকে। ডাক্তাররাও কি করবেন, তখন হাসপাতালে প্রায় শতাধিক গুলিবিদ্ধ আহত/শহিদ ছিলেন। তারা নিরুপায় হয়ে কাছের ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যান তাকে। ঐখানে নেওয়ার পরে তার চিকিৎসা শুরু হয়। তারপরে উন্নত চিকিৎসা এবং অপারেশনের জন্য একমাস পর তাকে নেওয়া হয় সিএমএইচ-এ। সেখানে তার শরীরে সফল অস্ত্রোপচার হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার ইব্রাহিমপুর গ্রামের সোহাগ সরকার (৪৬) ও রাবেয়া বেগম (৪০) দম্পতির একমাত্র ছেলে ইখতিয়ার। তার একমাত্র বড় বোন জুঁই উত্তরার আইইউবিএটি (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস এগ্রিকালচার এন্ড টেকনোলজি) এর কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারে অধ্যয়নরত। দুই সন্তানের উচ্চ শিক্ষার জন্য সোহাগ দম্পতি গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে দক্ষিণখানের সিএনজি পাম্প এলাকায় দুই রুমের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। ছোট ব্যবসা করেন। আন্দোলন-সংগ্রামের এই টালমাটাল অবস্থায় তাও এখন বন্ধ। বলা যায় তিনি বেকার।
হাসপাতালের দিনগুলোর কথা মনে করে ইখতিয়ার বলেন, ‘মাঝে মাঝে তীব্র যন্ত্রণায় মনে হতো বোধ হয় মরে যাচ্ছি। কষ্টের যন্ত্রণায় আল্লাহকে বলতাম, আল্লাহ মরণ দিয়ে দাও। এ কষ্ট যে আর সহ্য করতে পারছি না। তারপর একদিন পাশের বেডের একটা ছেলে যখন মারা গেল, তখন আরো মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তিন তিনবার ইনফেকশন হয়েছে। এক পর্যায়ে ইনফেকশন এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে, ডাক্তাররা প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারা মাংস কেটে ড্রেসিং করে ইনফেকশন থেকে তাকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তারপরে প্লাস্টিক সার্জারির চিন্তাও ডাক্তাররা করেছিলেন। কিন্তু সেটাও সফল হয়নি।
মহান প্রভুর একান্ত ইচ্ছা, আমার বাবা-মায়ের দু'আ এবং সর্বোপরি সিএমএইচ‘র ডাক্তারদের তীব্র প্রচেষ্টার কারণে কিছুটা সুস্থ হয়েছি। তারপর গত এক মাস নিয়মিত সিএমএইচ এ যেয়ে আমার অপারেশনের কাটাগুলোর ড্রেসিং করাচ্ছি। আর কতদিন যাওয়া লাগবে, তাও জানি না। আপনাদের কাছে দোয়া চাই যেন ঠিকমতো পরীক্ষাটা অন্তত দিতে পারি। ইতোমধ্যে সরকার আমাদের কথা চিন্তা করে এসএসসি পরীক্ষা দুই মাস পিছিয়েছে, এজন্য সরকারকেও আন্তরিক ধন্যবাদ।’
কথা হয় তাঁর স্কুলের শিক্ষক মুকুল স্যারের সাথে। তিনি বলেন, ‘এইরকম গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ও যেভাবে প্রাণচঞ্চল, আমরা ওকে দেখে ওর কাছ থেকে নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা পাই। এমনিতে ও প্রচন্ড মেধাবী, ক্লাসে খুব চটপটে। আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষ টেস্ট পরীক্ষা ছাড়া বিশেষ বিবেচনায় ওকে উত্তীর্ণ করে দিয়েছি। কারণ, এই অবস্থায় কীভাবে পরীক্ষা দিবে? এখন তার এসএসসি পরীক্ষার জন্য সবাই খুব চিন্তিত।’
কথা হয় তাদের বাড়িওয়ালা বাবু ভাইয়ের সাথে। তিনি বলেন, ‘বলতে গেলে পরিবারটি এখন খুবই অসহায়। দুটো বাচ্চার লেখাপড়া এবং ওর চিকিৎসার পেছনে বিশাল একটা খরচ। যদিও সরকার ভালো রকম কন্ট্রিবিউট করেছে কিন্তু চিকিৎসা তো চলমান। কবে নাগাদ ছেলেটি পরিপূর্ণ সুস্থ হবে, আমরা কেউ তা জানি না। ওর বাবা প্রায় বেকার। তাকে সরকার একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিলে পরিবারটা উপকৃত হতো।’
ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ক্রিসেন্ট হাসপাতালের তিন লক্ষাধিক টাকা মওকুফ করা হয়েছে। বিলটি সরকারের পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হবে। সিএমএইচ‘র ব্যয়বহুল পুরো চিকিৎসা ফ্রি করানো হয়েছে। এর মধ্যে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন এর পক্ষ থেকে তাদেরকে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে।
সবশেষে এই পরিবারের কাছে যখন জানতে চাওয়া হয়, রাষ্ট্রের কাছে আপনাদের কি আশা বা কি আকাঙ্ক্ষা? তখন ইখতিয়ার স্বভাব সুলভ একটি হাসি দিয়ে বলেন, ‘আমরা দেশটাকে সুন্দর দেখতে চাই। এমন একটি রাষ্ট্র হবে, যেখানে আর কোন মায়ের বুক খালি হবে না। বা আমার মতো কাউকে গুলি খেয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে না। আর অতি অবশ্যই যেন আহতরা যারা এখনো হাসপাতালে আছে, তারা যেন উন্নত চিকিৎসা পায়। যাদের বিদেশ নিয়ে চিকিৎসা করা দরকার, তাঁদের বিদেশ নিয়ে হলেও চিকিৎসা করিয়ে এই বীর যোদ্ধাদের পাশে যেন রাষ্ট্র দাঁড়ায়।’