শিরোনাম
প্রতিবেদন : আসাদুজ্জামান
সাতক্ষীরা, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : দরিদ্র রাজমিস্ত্রী বাবার পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে লেখাপড়া শেষ করে ভালো একটা চাকুরির স্বপ্ন দেখেছিলেন জিল্লুর রহমান। চেয়েছিলেন পরিবারের হাল ধরতে। কিন্তু তিনি নিজেই যে এখন পরিবারের বোঝা। দিন কাটছে আতংকে, অস্থিরতায়।
জিল্লুর রহমান সাতক্ষীরা সিটি কলেজের মাষ্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র।বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত জিল্লুর রহমানের সকল স্বপ্ন আজমরীচিকা হয়ে তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।
গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সাতক্ষীরা শহরের খুলনা রোড মোড় এলাকায় অবস্থিত এসপি বাংলো থেকে ছোঁড়া পুলিশের এক বুলেট তার পেটের ডান দিকে বিদ্ধ হয়। এতে তার পেটের ৯টি নাড়ী ছিদ্র হয়ে যায়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। পর পর দুই বার অপারেশনের পর তার সেই গুলি বের করেন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একদল অভিজ্ঞ চিকিৎসক। গুরুতর অসুস্থ জিল্লুর রহমান নিজ বাড়িতে বর্তমানে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
এদিকে ছেলের চিকিৎসা ও সংসারের খরচ জোগাড় করতে গিয়ে দরিদ্র রাজমিস্ত্রী বাবা আব্দুল খালেক রীতিমত চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। কবে তার সন্তান সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে তাও জানেন না তিনি।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাঁশদহা ইউনিয়নের পাঁচরকি গ্রামের দরিদ্র রাজমিস্ত্রী আব্দুল খালেকের(৫৫) বড় ছেলে জিল্লুর রহমান(২৩)। সে সাতক্ষীরা সিটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। জিল্লুরের মায়ের নাম তফুরা বেগম(৪০)। তিনি পেশায় গৃহিণী। মেজ ভাই আসাদুজ্জামান (২৪) পেশায় একজন টাইলস মিস্ত্রী। আর ছোট ভাই রাশিদুজ্জামান(২০) পেশায় একজন রাজমিস্ত্রীর সহকারী।
গুলিবিদ্ধ আহত জিল্লুর রহমান জানান, গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলনে আমিসহ আমার বন্ধুরা যোগ দিয়েছিলাম। জোহরের নামাজ শেষে আমি ও আমার সহযোদ্ধারা এসপি বাংলোর দিকে যাচ্ছিলাম। এসময় পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে আচমকা গুলি ছোঁড়ে। এতে আমার পেটে এবং আমার সহযোদ্ধা নাহিদের পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আমরা গুরুতর আহত হই। আমার পেটের ডান দিক থেকে ভিতরে গুলি ঢুকে ৯ টি নাড়ী ছিদ্র হয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এসময় আমার সহযোদ্ধাসহ স্থানীয় লোকজন আমাদের উদ্ধার করে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেন। সেখানে প্রায় দুই মাস চিকিৎসা নেই। পর পর দুই বার অপারেশন শেষে আমার পেটের ভেতর থেকে গুলি বের করা হয় এবং ছিদ্র নাড়ী গুলো জোড়া লাগানো হয়।
তিনি বলেন, আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি ছুঁড়লেও আজও পর্যন্ত দোষী ওই সকল পুলিশের বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সে দিনের সেই অজানা আতংক এখনো মনের মধ্যে বিরাজ করছে।
এসময় জিল্লুর এঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানান। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া শেষ করে ভালো একটা চাকুরি করে দরিদ্র পরিবারের হাল ধরার। কিন্তু আজ তা নিরাশায় পরিণত হয়েছে। দরিদ্র বাবার পক্ষে আমার লেখাপড়া তো দূরের কথা চিকিৎসাভার বহন করাই এখন খুবই কষ্টসাধ্য বিষয়।
তিনি আরো বলেন, দিন যতই যাচ্ছে আমি যেন আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছি। গায়ে বল পাচ্ছিনা। ঠিকমত এখন খেতেও পারিনা। তিনি এসময় তার লেখাপড়া ও চিকিৎসাভার গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান।
জিল্লুরের মা তফুরা বেগম বলেন, অনেক কষ্ট করে বড় ছেলেটা লেখাপড়া শিখছিল। আর ছোট দুই ছেলের তো টাকার অভাবে লেখাপড়া অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছি। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া দিতে পারিনা। ভালো কাপড় চোপড়ও দিতে পারি না। তার ওপর লেখাপড়ার খরচকিভাবে চালাবো। তাই দুই ছেলের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছি। আর বড় ছেলেটা সে নিজেই অনেক কষ্ট করে টিউশনি করিয়ে তার নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেই চালাচ্ছিল। কিন্তু গত ৫ আগস্ট ছেলে আমার কলেজে যাওয়ার নাম করে সাতক্ষীরা শহরে গেলো। তারপর কি যে হলো তা বুঝলাম না । পুলিশ আমার নিরীহ ছেলেটাকে কেন যে গুলি করলো তা তো জানতে পারলাম না। গুলিবিদ্ধ হয়ে সে দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। টাকার অভাবে তাকে ভালো মন্দ খেতেও দিতে পারিনা।
কান্না কাটি করে, ব্যাথা ও যন্ত্রনায় এখনো ছটফট করে আর আল্লাহকে ডাকে। ছেলেটা এখন ঠিকমত খেতেও পারেনা। দিন যত যাচ্ছে ততই সে রোগা হয়ে যাচ্ছে। গায়ে কোন বল পায়না। তিনি এসময় কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘ছেলে আমার খুবই হতাশ হয়ে পড়েছে। আমাকে বার বার বলে, মা আমার এখন কি হবে।
তিনি এসময় তার ছেলের জন্যে সরকারের কাছে একটি সরকারি চাকুরিরদাবি জানান।
আহত জিল্লুরের বাবা রাজমিস্ত্রী আব্দুল খালেক বলেন, ‘আমি অনেক কষ্ট করে রাজমিস্ত্রীর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করি। টাকার অভাবে আমার মেজ ছেলে আসাদুজ্জামান ও ছোট ছেলে রাশিদুজ্জামানকে লেখাপড়া শেখাতে পারিনি। মেজ ছেলে টাইলস মিস্ত্রীর কাজ করে ও ছোট ছেলে রাজমিস্ত্রীর সহকারী হিসেবে কাজ করে। আর বড় ছেলেটা অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করছিল, কিন্তু গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় আমার ছেলেকে পুলিশ গুলি করে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে প্রায় দুই মাস যাবত সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। আমার আত্নীয় স্বজন ও এলাকার লোকজন কিছু সাহায্য করলেও সরকারিভাবে তেমন কোন সহযোগিতা পাইনি। সে তো আর ভারী কোন কাজ করতে পারবেনা। তাই আমাদেরদাবি, সরকার যেন আমার ছেলেটার একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়। যাতে সে আগামী দিনগুলোতে ভালভাবে চলতে পারে।
সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডাঃ আব্দুস সালাম জানান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ও নিহতদের চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুতের কার্যক্রম চলছে। খুব তাড়াতাড়ি একটি চূড়ান্ত রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করা হবে।
তিনি আরো জানান, চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরির পর আহতদের চিকিৎসাসেবাসহ পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।