শিরোনাম
প্রতিবেদন : মোঃ মঞ্জুর মোর্শেদ
মুন্সীগঞ্জ ১ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস ) : ফরিদ শেখের আড়াই বছরের শিশু কন্যার মুখে জুটছে না নিয়মিত শিশু খাদ্য। পুলিশের একটি গুলিতে ফরিদের সংসারের সবকিছু ওলট পালট আজ। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন ফরিদ শেখ। এখন তার পরিবারে শুধুই অন্ধকার।
ছোট্ট আড়াই বছরের শিশু কন্যা ফাতেমা আক্তারকে এতিম করে চলে গেলেন ফরিদ। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী ইতি আক্তারের সাথে শ্বশুর বাড়ীর টানা পোড়েন শুরু হয়। ইতি আড়াই বছরের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন পিতার অভাব অনটনের সংসারে। বাবা ঢাকায় আছে বললে আদরের অবুঝ ফুটফুটে শিশু কন্যা ফাতেমা আশায় থাকে বাবা সেখান থেকে‘মজা’ নিয়ে আসবে। পরক্ষণেই হারিয়ে যায় আবার খেলার জগতে। বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারলো না ফাতেমা।যে দিন জানবে পিতার মৃত্যুর ঘটনা সেদিন তার সামনে চলে আসবে এক ভয়ংকর ইতিহাস।ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করবে হাসিনার ফ্যাসিষ্ট দোসরদের।
ফরিদের মৃত্যুর তিন মাস পরেও মা অপেক্ষায় থাকেনছেলের ফোনের জন্য। আদরের প্রথম পুত্র ফরিদের শোকে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে তার।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়নের সুখবাসপুর গ্রামের মোঃ সুলতান শেখের বড় পুত্র মোঃ ফরিদ (৩১)। সাত ভাই বোনের মধ্যে ফরিদ ছিলেন পিতা-মাতার আদরের বড় ছেলে। পাঁচ বোনের পর জন্ম নেয়ায়তিনি ছিলেনবিশেষ আদরের। অথচ সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হলো সবার আগে।
ফরিদের পিতা মোঃ সুলতান শেখ(৭০) বাসসকে বলেন , ‘ফরিদ স্থানীয় বছিরননেছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে। সংসারে অভাবের কারণে পড়াশুনা বেশি করতে পারেনি। আমি দীর্ঘদিন হিমাগারে কাজ করায় শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। কোন কাজ করতে পারিনা। সংসারে হাল ধরতে ফরিদ দেড় বছর আগে ঋণ নিয়ে তিন সিঁড়িতে ফোনের দোকান দেয়। ব্যবসায় মার খেয়ে তা বন্ধ হয়ে যায়।অভাবের সংসারে সুখ আনতে ঢাকার যাত্রাবাড়িতে চাচাত ভাই নুরুল আমীনের কলার আড়তে কাজ শুরু করে। ঢাকায় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে ফরিদ কাজের ফাঁকে আন্দোলনে চলে যেত।
তিনি আরো বলেন, ‘ফরিদ এলাকায় থাকার সময় বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। গত ৪ আগস্ট সকাল ১১ টার দিকে যাত্রবাড়িতে পুলিশের গুলি তার পেটে বিদ্ধ হলে সে রাস্তায় পড়ে যায়। আন্দোলনকারীরা স্থানীয় কয়েকটি ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করার চেষ্টা করে। প্রত্যেক ক্লিনিকে আহত রোগীতে ভর্তি থাকায় চিকিৎসা করাতে পারেনি। পরে মুগদা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পেটের গুলি বের করতে অপারেশন লাগে। ঐ সময় ফরিদের চাচাত ভাই নুরুল আমীন ফোন করে জানায়, ফরিদ গুলি খেয়েছে, হাসপাতালে আছে। দেশে গন্ডগোল থাকায় ঢাকায় যেতে পারিনি। পরদিন ভোরে ঢাকায় মুগদা হাসপাতালে যাই।’
দুই দিন হাসপাতালে অজ্ঞান অবস্থায় ছিল ফরিদ। অপারেশনের পরেও আর জ্ঞান ফেরে নাই। গত ৬ আগস্ট হাসপাতালেই মারা যায় সে। ঐ দিনই তিনসিঁড়িতে এনে দাফন করা হয়।
ফরিদের পিতা জানান , জেলা প্রশাসন থেকে ২০ হাজার এবং জামায়াতের পক্ষ থেকে দুই লক্ষ টাকা সহায়তা হিসেবে দেয়া হয়েছে।
নিহত ফরিদের স্ত্রী ইতি আক্তার(১৯) একমাত্র কন্যা সন্তান ফাতেমাকে নিয়ে এখন সদর উপজেলার বাংলাবাজারে পিতার বাড়িতে আশ্রয়ে আছেন।
ইতি আক্তার বাসসকে বলেন , কন্যা ফাতেমা বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারলো না। এই আফশোস আমি কোথায় রাখি? বাবা ঢাকায় আছে বললে মেয়ে বলে বাবা মজা নিয়ে আসবে? যারা আমার সন্তানকে এতিম করলো আল্লাহ তাদের বিচার করবে। এতিম সন্তানকে নিয়ে এখন আমি কোথায় যাবো? শ্বশুর বাড়ির সাথেও সর্ম্পক এখন ভালো নেই। সেখানে যেতে পারছি না। বাবার বাড়িতেই বা কতদিন থাকবো। বাবা ফারুখ গাজী মিশুক চালক । বাবার একার উপার্জনে চার জনের সংসারে অভাব অনটনের মধ্যে মেয়েটাকে মানুষ করবো কি করে?
আগামী দিনের অজানা এক চিন্তায় দিশেহারা ইতি আক্তার আরো বলেন,বিশ হাজার টাকা শুধু পেয়েছি। জামায়াতে ইসলামী থেকে শ্বশুর যে দুই লক্ষ টাকা পেয়েছেনসেখান থেকে কিছুই আমি পাইনি।
এ সময়ে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। অশ্রুভেজা চোখে ইতি বলতে থাকেন, ‘স্বামীর সংসারও করতে পারলাম না, শ্বশুর বাড়ীতেও এখন স্থান হচ্ছে না। জীবনের বড় সম্পদ স্বামীকে হারিয়েছি।’
এতিম সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে প্রশাসনসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন ইতি।
ফরিদের মা আলো বেগম চোখের পানি মুছতে মুছতে বাসসকে বলেন, ‘পাঁচ মেয়ের পর ঘর আলো করে আসে ফরিদ। আদরের সে ছেলেটাকে পুলিশ গুলি করাইয়া মাইরা ফেললো।দুই দিন হাসপাতালে বেহুঁশ থাইকা কিছু না বইলা মইরা গেলো। আমার ছেলেডা আর ফেরত আসবে না। আমি আমার ছেলের খুনির বিচার চাই।’