শিরোনাম
প্রতিবেদন : সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন
ঢাকা, ১ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থান যখন সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে ব্যাপক আকার ধারণ করে তখনই জুয়েল এ আন্দোলনে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
একটি বেসরকারি কোম্পানির টেকনিশিয়ান জুয়েল বুঝতে পেরেছিলেন যে নির্মম বৈষম্যের শৃঙ্খলে আটকে থাকা মানুষের মুক্তির জন্য তার জীবন উৎসর্গ করার সময় এসেছে।
গত ৩ আগস্ট রাতে স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় জুয়েল (৩৪) বলেছিলেন, ‘আন্দোলনে গিয়ে আমি শাহাদাত বরণ করলে আল্লাহ আমার সন্তানদের হেফাজত করবেন।’
বাড়ির চুলায় গ্যাস না থাকায় ৩ আগস্ট রাতে জুয়েলের স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার পাশের বাড়ির স্টোভে রান্না করতে গিয়েছিলেন। সেই রাতে ১২টার দিকে জুয়েল তার স্ত্রীর সাথে কথা বলার জন্য রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বলেন।
‘কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই আমি অনুমান করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি আমাকে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার বিষয়ে কিছু বলতে চান? তিনি উত্তর দেন, হ্যাঁ, আমি আগামীকাল আন্দোলনে যাব’, আন্দোলন নিয়ে স্বামীর সঙ্গে তার কথোপকথনের কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন সুমাইয়া।
জুয়েল-সুমাইয়া দম্পতির দুই সন্তানের মধ্যে বড় কন্যা সিদরাতুল মুনতাহার বয়স সাড়ে ৩ বছর এবং ছোট পুত্র মোঃ আব্দুল্লাহ’র বয়স ১০ মাস। তাদের কথা ভেবে জুয়েলকে আন্দোলনে যাওয়া থেকে বিরত করার জন্য সুমাইয়া বলেন, ‘আমাকে নিয়ে ভাবার দরকার নেই, তবে দয়া করে আপনার দুই শিশু সন্তানের
কথা ভাবুন। আপনার কিছু হলে তারা এতিম হয়ে যাবে।’
কিন্তু জুয়েল তার বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান এবং আরও দুই ভাইবোনের ভালোবাসা, স্নেহ এবং গভীর বন্ধনকে উপেক্ষা করেই আন্দোলনে যোগ দেন।
প্রকৃতপক্ষে জুয়েলের মতো হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণই বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিণত করেছিল, যা স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলো।
আন্দোলনে যোগদানের আগের রাতে স্বামীর সাথে আলোচনার স্মৃতিচারণ করে সুমাইয়া আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে জানান, স্বামীকে আন্দোলনে যোগদানে বাধা দিতে গভীর আবেগপূর্ণ শব্দ দিয়ে কথা বলেন এবং সন্তানদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেন। কিন্তু তবু স্বামীকে আন্দোলনে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেননি।
বরং জুয়েল ৪ আগস্ট আন্দোলনে যোগ দেয়ার ব্যাপারে তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় সুমাইয়া শেষ বিকল্প হিসাবে স্বামীর পা ধরে মিনতি করেন। কিন্তু সেসময় তার স্বামী তাকে বলেন, ‘বউদের কথা শুনে মানুষ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিলে দেশ স্বাধীন হতো না। চিন্তা করো না, আমার কিছুই হবে না। আর যদি আমি শাহাদাত বরণ করি তাহলে দেশের জন্য আত্মত্যাগ করার সৌভাগ্য হবে।’
জুয়েল সেদিন তার স্ত্রীকে আরো বলেন, ‘তুমি হবে একজন শহিদের গর্বিত স্ত্রী। আমার সন্তানরা বলতে পারবে তাদের বাবা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। আল্লাহ আমার সন্তানদের দেখাশোনা করবেন।’
সুমাইয়া বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় জুয়েল তার পরিবারের সদস্যদের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে উৎসাহ দিতেন এবং বলতেন অনেক অভিভাবক আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন।
জুয়েলের শাহাদাতের দিনটির স্মৃতিচারণ করে তার শোকার্ত স্ত্রী বলেন, জুয়েল সকাল ১১টার দিকে ঘুম থেকে ওঠেন এবং হাতমুখ ধুয়ে বাইরে যেতে চান।
কিন্তু সে সময় তাকে বাধা দেই। তার কিছুক্ষণ পরই তিনি কোথাও চলে যান এবং বিকেল ৪টার দিকে বাসায় ফিরে দুপুরের খাবার খেতে চান।
সুমাইয়া কান্না সংবরণ করতে করতে বলেন,‘আমি সেই সময় রান্নাঘরে ছিলাম। আমি তাকে খাবার টেবিলে বসতে বললাম এবং আমার শাশুড়ি আম্মা তাকে ভাত দেবেন বলে জানালাম। কিন্তু তিনি আমাকে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ডাকছিলেন। তখন তিনি পরিবারের সবার সাথে দুপুরের খাবার খেতে চান। আমি আসতে দেরি করলে তিনি আমাকে বকাঝকা করেন। সেদিন আমরা সবাই মিলে দুপুরের খাবার খেয়ে আমি আবার রান্নাঘরে গেলাম।’
জুয়েলের বাবা সিরাজুল ইসলাম (৬৫)বলেন, ‘আমার ছেলে সবসময় একা বসে খাবার খেতো। পরিবারের সবার সাথে কখনোই এক সাথে বসে খাবার খায়নি। কিন্তু সেদিন সবাইকে ডাইনিং টেবিলে ডেকে একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেলো।’
জুয়েলের ছোট ভাই ডেমরা ইউনিভার্সিটি কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মোঃ আল আমিন জানান, দুপুরের খাবারের পর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তার ভাই কারও ফোন পেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান।
ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন,‘ভাইয়া যখন বাইরে যাচ্ছিলেন, তখন বিকেল হয়ে গেছে। সেজন্য আমি তাকে সেসময় আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলাম এবং পরের দিন সকালে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু ভাইয়া আমার কথা শোনেননি।’
জুয়েলের স্ত্রী সুমাইয়া বলেন, ‘বিকেল ৫টার দিকে রান্নাঘর থেকে নিজের ঘরে এসে দেখি তিনি নেই। আসরের নামাজের সময় হওয়ায় আমি আগে নামাজ পড়ে বিকেল ৫.১৭ মিনিটের দিকে তাকে ফোন করি।’
‘আমি নামাজ পড়ার সময় অস্থির বোধ করছিলাম। তাই, নামাজ শেষ করার পর দ্রুতই তাকে ফোন করি। তখন তিনি জানান যে তিনি শনির আখড়ায় আছেন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে তিনি কেন আমাকে বলে যাননি, ফোনে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যদি আমি তোমাকে বলে আসতাম, তাহলে তুমি আমাকে বাইরে আসতে দিতে না। তাই কাউকে জানাইনি।’
প্রাইভেট মেডিকেলের ফিডব্যাক অফিসে কর্মরত জুয়েলের ছোট বোন শারমিন সুলতানা নিজেও আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। সেদিন বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে তিনি যখন দুই কার্টন বিস্কুট, ওরস্যালাইন এবং পানি নিয়ে সাইনবোর্ড এলাকায় আন্দোলনরত মানুষকে সাহায্য করতে যাচ্ছিলেন তখন তাদের বাড়ির সামনে তার ভাই জুয়েলের সাথে দেখা হয়। সেসময় তিনি জুয়েলকে তার সাথে সাইনবোর্ড এলাকায় যাওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু জুয়েল তাকে বলেন যে তিনি শনির আখড়ায় আন্দোলনে যোগ দেবেন।
সেদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ জারি করায় আল আমিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তার ভাইকে ফোন করে বাসায় আসতে বলেন। একথা শুনে জুয়েল তাকে শনির আখড়ায় অনেক লোক আছে জানিয়ে বলেন, ‘কারফিউচাপিয়ে দিয়ে কি আন্দোলন দমন করা সম্ভব’?
আল আমিন বলেন, ‘সন্ধ্যা ৬.১০ মিনিটের দিকে আমি ভাইয়াকে আবার ফোন করি। কিন্তু আমি তার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। কিছুক্ষণ পর, কেউ ফোন রিসিভ করে বললো যে আমার ভাই গুলিতে আহত হয়েছেন এবং তিনি আমাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) যেতে বলেন। আমি এবং আমার বোন বাড়ির কাউকে না জানিয়ে হাসপাতালে চলে যাই। কারণ বাবা হার্টের রোগী।’
আল আমিন জানান, পরে জানতে পারেন যে জুয়েল কাজলা এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন এবং একটি ছবিতে দেখা যায় তার বুকের বাম পাশে একটি গুলি বিদ্ধ হয়েছে।
আল আমিন বলেন, আমরা ঢামেক হাসপাতালে পৌঁছালে সেখানে দুই ছাত্র আমাদের জানায় যে তারা শনির আখড়া থেকে মোট পাঁচজনকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে চারজন আহত এবং একজন মারা গেছে।
আল আমিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘তাই, প্রথমে আমরা আহতদের দেখেছি, কিন্তু তাদের মধ্যে আমার ভাইকে পাইনি। সেই সময় আমার বন্ধু আমার আপুকে ফোন করে বাড়িতে ফিরে আসতে বলে। ততক্ষণে আমার ভাইয়ের লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
জুয়েলের স্ত্রী জানান, সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিনি একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন পেয়েছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন যে তাদের পরিবারের কেউ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে কিনা।
তিনি বলেন, ‘আমি বলেছিলাম যে আমার স্বামী আন্দোলনে গেছেন। সন্ধ্যা ৭.৪৭ টার দিকে একই নম্বর থেকে আরেকটি ফোন আসে। তিনি আমাকে বলেন, আপনার স্বামী মারা গেছেন।’ কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন সুমাইয়া।
তিনি বলেন, ওই ব্যক্তি আমাদের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে লাশ পাঠান। ‘আমি তাকে ঠিকানা দিয়েছিলাম কারণ আমি জানতাম না যে আমার দেবর ও ননদ তাদের ভাইকে খুঁজতে বেরিয়েছিল।’
দুই শিশু সন্তানের ভবিষ্যত ও তাদের লেখাপড়ার চিন্তায় সুমাইয়া এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন।
তিনি বলেন, ‘এখন পড়ালেখা অনেক ব্যয়বহুল। তাই আমি চাই সরকার আমার সন্তানদের জন্য কিছু করুক।’ তিনি সরকারের কাছে তার স্বামী হত্যার বিচার দাবি করেন।
জুয়েলের ভাই আল আমিন জানান, তারা দুই দফায় আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। প্রথম ১৭ জুলাই থেকে ২০শে জুলাই, যখন আবু সাঈদের মৃত্যুর পর ছাত্র আন্দোলন সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে গণআন্দোলনে পরিণত হয়।
আল আমিন বলেন, ‘সেসময় আমরা দেখেছি আমাদের সামনে অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।’
পরে, তারা ২ আগস্ট থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেন। ৪ আগস্ট তার ভাই শাহাদাত বরণ করেন।
জুয়েলের বাবা সিরাজুল ইসলাম আগে গার্মেন্টস-এ চাকরি করতেন। কিন্তু হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় এখন আর তিনি কাজ করতে পারেন না। গত ১৫ জুলাই তার ধমনীতে একটি স্টেন্ট স্থাপন করা হয়। জুয়েল ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বড় ছেলেকে হারিয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের মৃত্যুতে আমার সুন্দর পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা জানি না আমাদের সামনের দিনগুলো কিভাবে চলবে!’
তিনি জানান, ছোট ছেলের টিউশনি এবং মেয়ে শারমিন সুলতানার সহায়তায় তাদের কোনরকমে দিন চলছে।
ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই জুয়েলের মা নিলুফা বেগম অসুস্থ। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত জুয়েলের মা বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে এক মিনিটের জন্যও ভুলতে পারছি না । আমি আমার ছেলের স্মৃতিতেই ডুবে আছি।’