বাসস
  ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৯
আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২২

কেকের ওপর মোম জ্বলছে, ফুঁ দিয়ে নেভানোর মানুষটি আর নেই

প্রতিবেদন : নুসরাত সুপ্তি
নারায়ণগঞ্জ, ২ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা। প্রতি বছরের মতো এবারো মেয়ের জন্মদিনে কেক নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন দীপক কুমার। তার একমাত্র মেয়ে রিয়া। আজ তার জন্মদিন।

সকাল থেকেই বাবার অপেক্ষায় প্রহর গুণতো রিয়া। বাবা দরজায় কড়া নাড়লেই দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিত। তবে এবার আর দরজার কাছে আসেনি কেউ। ডাকেনি বাবা বলে।

বাবা কেক নিয়ে আসছো বলে বাবাকে বুকেও জড়িয়ে ধরেনি কেউ। কারণ রিয়া নেই। সে আর ফিরবে না কোনদিন। বাবার আনা কেকের ওপর মোম জ্বলছে, কিন্তু ফুঁ দিয়ে নেভানোর মানুষটি আর নেই।

এই কদিন আগেই রিয়ার ছয় বছর পূর্তি উপলক্ষে কেক সামনে নিয়ে বসেছিলেন তার বাবা মা। আর কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন অঝোরে।

রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে ছেলে ও ছেলের স্ত্রীর শোকাবহ ও বেদনাদায়ক এই দৃশ্যের বিষয়ে কথা বলছিলেন রিয়ার দাদী মিনা গোপ (৭০)।

রিয়া গোপ ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে অকালে ঝরে যাওয়া একটি নাম।  মেধাবী শিক্ষার্থী রিয়া নয়ামাটি প্রাইমারি স্কুলের ১ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন।

গত ১৯ জুলাই বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সারা দেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। চারিদিকে ছাত্র-জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল। রিয়াদের বাড়ির চারিদিকেও গোলাগুলির শব্দ হচ্ছিল। শব্দ শুনে কৌতুহলে রিয়া দৌড়ে বাড়ির ছাদে ওঠে। তার পিছু নেয় রিয়ার বাবা দীপক কুমার (৪৮)। মেয়েকে কোলে নিতেই ভয়ংকর এক শব্দে আঁতকে উঠেন তিনি। কিছু বুঝে উঠার আগেই রক্তে ভিজে যায় তার পুরো শরীর। বুলেট এসে বিদ্ধ হয় রিয়ার মাথায়। মুহূর্তেই ঢলে পড়ে সে বাবার কোলে। আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিন দিন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়। ২৪ জুলাই চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে জেলার মাসদাইর শ্মশানে রিয়াকে দাহ করা হয়।

শহরের নয়ামাটি এলাকার রিয়ার পরিবারের বসবাস। সেখানের দ্বীনবন্ধু মার্কেটের ৪র্থ তলায় তারা থাকেন।  সম্প্রতি তাদের বাসায় গিয়ে দেখা যায় বাড়িতে সুনসান নীরবতা। দরজায় কড়া নাড়লে এক বৃদ্ধা এসে দরজা খুলে দেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কথা প্রথমে কথা বলতে না চাইলেও পরে তিনি বলেন, কথা বলে আর কি হবে? যে চলে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না। ছোট্ট একটা শিশু তার পিছন থেকে উঁকি দেয়। দরজায় নতুন মানুষ দেখে দৌড়ে চলে যায় ভিতরের কক্ষে।  শিশুটিকে দেখিয়ে রিয়ার দাদী মিনা গোপ বলেন, রিয়ার চাচাতো বোন স্নিগ্ধা।  রিয়ার মৃত্যুর পর নতুন মানুষ দেখলেও ভয় পায়।

রিয়ার সমবয়সী চাচাতো বোন স্নিগ্ধা গোপ। দিনের পুরো বেলাই কাটত দুইবোনের একসাথে।  রিয়ার রক্তাক্ত মৃত্যু দেখে স্নিগ্ধাও স্তব্ধ হয়ে গেছে। দু’বোনের কোলাহলে যে ঘর মুখরিত হয়ে থাকত, সে ঘরে এখন কেবলই  নীরবতা।  নতুন কোন মানুষের সামনেই সে আর যায় না। মৃত্যুভয় যেন তাকেও জেঁকে ধরেছে।

মিনা গোপ বলেন, ‘নাতিন দুইটা সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করত ঘরে বাইরে। রিয়াটায় বেশি চঞ্চল আছিলো। কিন্তু এখন পুরা ঘরটাই ঠান্ডা হইয়া গেছে।  সিন্ধায় ঢড়ায়। ছাদেও যায় না। আমার ঘরেই আমার নিরাপত্তা নাই। বাড়িতে আইসা হামলা হইবো, নাতিন মরব এটা কি মাইনা নেওয়া যায়?’

রিয়ার মায়ের কক্ষে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে ঘরের এক কোণে বসে আছেন বিউটি ঘোষ(৩৪)। তাকিয়ে আছেন দেয়ালে ঝুলে থাকা মেয়ের ছবির দিকে। মেয়ের কথা শুনেই নিস্তব্ধতা কাটিয়ে আহাজারিতে কেঁদে উঠেন তিনি।

অশ্রুভেজা কন্ঠে বলেন, ‘আমার বাচ্চাটা ভাত খাইতেছিল। আওয়াজ পাইয়া না খাইয়া দৌড়ে ছাদে গেল। বললাম যাইয়ো না মা। বলল, মা আসতাছি।  সেই যে গেলো আর বুকে ফিরলো না মাইয়াটা। বিয়ের পর সাড়েচার বছর চিকিৎসা করে রিয়া হইছিল। আমার একটা মাত্র মাইয়া। অনেক চঞ্চল ছিল,  আবার নাচে আবৃত্তি পড়াশোনায় ছিল অনেক ভালা।  ক্লাসে প্রথম হইছিল। আর বাচ্চা হইবো কিনা জানি না,  ওরে নিয়া অনেক স্বপ্ন ছিল আমার। আমার রতন রে এমনে মাইরা ফেলবো এটা তো কোন দিন দুঃস্বপ্নেও ভাবি নাই। এতো কান্দি, চোখের পানি শুকায় না। পড়তেই থাকে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সবাই বলতাছে আবার সন্তান নেওয়ার জন্য।  আমার প্রথম বাচ্চা হয়েছে অনেক চিকিৎসার পর। সেই চিকিৎসার খরচ করছে আমার শ্বশুর।  তিনি এখন বেঁচে নাই।  আমার স্বামীও রিয়ার মৃত্যুর পর থেকে আমার মতন কেমন যেন দিশাহীন হয়ে গেছে। আক্ষেপে নিজের শরীরে পিটায়। সে কাপড়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করে।

কিন্তু  আগের মতো আর কাজও করতে পারে না। নতুন করে চিকিৎসার খরচ কোথায় পাবো?  কিন্তু আমি রিয়ারে ফিরে পেতে চাই। ওর মতোই একটা সন্তান চাই আমি ঈশ্বরের কাছে। হায়! ঈশ্বর যদি আমার রিয়ারে ফিরায় দিতো।’

মেয়ের রক্তে ভেজা শরীর আজো ঘুমাতে দেয় না দীপক কুমারকে। শোকে শোকে প্রায়পাথর দীপক কুমার বলেন, ‘আমি আমার মেয়ে হারিয়েছি। মেয়ের লাশ কাঁধে নেওয়া যে কত কষ্টের সেটা আমি কিভাবে বলব? আমি মেয়েকে কোলে নিলাম, আর সাথে সাথে মেয়েটার মাথায় আইসা গুলিটা লাগল। ওরে কোলে না নিলে তো আমি মারা যাইতাম। আমার মরণ আমার মেয়ে নিয়া গেল। এই কথা আমি কেমনেভুলব। আমি জীবিত থাইকাও মৃত। এটা কোন জীবন আমার!’

তিনি আরও বলেন, ‘রিয়া হত্যা নিয়ে আমরা কোন মামলা করিনি। কে মেরেছে জানি না, কার নামে মামলা করব। মৃত্যুর পর পর কয়েকজন সাহায্য করতে চাইছিল। তখন টাকা নেই নাই। ডিসি অফিস (জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) থেকে সাহায্য করবে বলেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন আর্থিক সহয়তা আমরা পাই নাই।’

প্রতিবেশী মামুন এ বিষয়ে বলেন, সেদিনের পর থেকে রিয়ার পরিবারের মানুষকে তেমন একটা বাইরে বের হতে দেখা যায় না।  দীপক ভাইও দোকানে আগের মতন যায় না। বাচ্চাটার রক্ত মাখা মুখটার কথা মনে পড়লে আর ভালো লাগে না।  ছাত্র-জনতার বিজয়ে দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু পরিবারটি ডুবে আছে শোকের সাগরে।