শিরোনাম
প্রতিবেদন: বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : আমরা তো চিরদিন বেঁচে থাকব না। আমরা মরে গেলে ছেলেটার কী হবে? কে দেখে রাখবে ছেলেটাকে? প্রায় চার মাস হতে চললো ছেলেটা এখনও উঠে দাঁড়াতে পারে না, হাঁটা চলা করতে পারে না।
সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের শয্যায় বসে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমন কথা বলেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ মো. হাফিজুর রহমান হাবিবের মা হালিমা বেগম (৩৫)। কথাগুলো বলতে বলতে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন।
তিনি বলেন, ‘ডাক্তার আমাকে বলেছেন, হাবিবের এক পা অচল হয়ে গেছে। এই পা ভালো হওয়ার সম্ভবনা খুব কম। আমরা তো চিরদিন বেঁচে থাকব না।
আমরা মরে গেলে ছেলেটার কী হবে? কে দেখে রাখবে ছেলেটাকে?’
কাঁদতে কাঁদতে হাবিবের মা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেন। কিছুক্ষণ পর শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে হালিমা বেগম বলেন, ‘ছেলেটাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি। ওর ভবিষ্যত কি হবে? কে দেখবে ওকে। ওকে যেন কারও বোঝা হয়ে থাকতে না হয়, সরকার সে রকম একটা ভাতার ব্যবস্থা করে দিক।
সরকারি ভাতা পেলে ছেলেটা চিকিৎসা করানোসহ অন্তত খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে।’
হাবিব দিনাজপুর জেলার চিনিবন্দর থানার জোৎস্নাতনালা গ্রামের বাসিন্দা। হাবিবের বয়স ১৭ বছর। তার বাবা রফিকুল ইসলামের বয়স ৪০। তিনি সাভার আশুলিয়ার শ্রীপুর মাদারগেট এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন। স্থানীয় একটি গার্মেন্টসের কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবে চাকুরি করেন। হাবিবরা দুই ভাই ও এক বোন। এর মধ্যে হাবিব মেজো। বড় ভাই মো. হান্নান ইসলামও গার্মেন্টেসে চাকরি করেন। তবে তিনি বিয়ে করে স্ত্রী নিয়ে আলাদা থাকেন। হাবিবের নয় বছরের একটা ছোট বোন রয়েছে, নাম রাইয়ানা তাবাচ্ছুম। সে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। হাবিরের এ বছর অষ্টম শ্রেণিতে উঠার কথা ছিল।
হাবিবের বাবা বলেন, ‘গত তিন মাস ধরে ছেলেটা হাসপাতালে ভর্তি আছে। ছেলেটা এখনো প্রস্রাব-পায়খানা করার বিষয়টি বলতে পারে না। ওর বাম পা অবশ হয়ে আছে। প্রচন্ড ব্যথা। এই ব্যথা কমানোর কোন কি ওষুধ নাই? এটার কি কোথাও কোনো চিকিৎসা নেই? ডাক্তাররা বলছেন, বাংলাদেশে ওর আর চিকিৎসা নেই। কিন্তু দেশের বাইরে তো আছে। সরকার তাকে বাইরে চিকিৎসা করাতে নেবে কি না, সেই বিষয়ে আমাদের কিছু বলছেও না। শুনলাম তালিকা হয়েছে, তাতে হাবিবের নাম আছে। কিন্তু প্রায় চার মাস হয়ে গেলো তাকে তো বিদেশে পাঠানো হচ্ছে না।’
রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার একার চাকরিতে চারজনের সংসার চলে। এদিকে ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে। এখন ছেলের চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। পরিবার নিয়ে টিকে থাকাই দায় হয়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে শুধু ছেলের খাবার দেয়। আমি আর আমার স্ত্রীর খাবার কিনে খেতে হয়। চার মাস গার্মেন্টস থেকে ছুটি নিয়েছি। ছুটিও শেষ। আমি গিয়ে চাকরি করব, তারও কোনো উপায় নেই। চাকুরি চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমি এখন কি করবো ভেবে পাই না।
তিনি বলেন, ‘ছেলেকে ওর মা একা ওঠানামা করাতে পরে না। কিছু কেনা লাগলে তাও কিনে আনতে পারবে না। সরকার এক লাখ টাকা দিয়েছে। তা তুলতে অনেক ভোগান্তি হয়েছে। প্রায় এক মাস পরে তুলতে পেরেছি। কারণ হাবিবের বয়স ১৭ বছর। ওর নামে চেক দেওয়ায় ব্যাংক থেকে সঙ্গে সঙ্গে টাকা তুলতে পারিনি।’
সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে হাসপাতালের বেডে শুয়ে হাবিব বলেন, স্কুলের বড় ভাই ও বন্ধুদের সঙ্গে আশুলিয়ার ইপিজেড এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিতাম। গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর আমরা বিজয় মিছিল নিয়ে যখন আশুলিয়া থানার সামনে যাই তখন আচমকা পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি শুরু করে। তখন একটা গুলি আমার কোমরে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে আমি পড়ে যাই। অপরিচিত তিন বড় ভাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেই হাসপাতালে ডাক্তার ছিল না। ওখানকার ওয়ার্ডবয়রা গজ দিয়ে আমার কোমরে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিল। পরে ওই হাসপাতালের ডাক্তাররা আমাকে পাঠিয়ে দেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে।
তিনি বলেন, ‘সেখানে কয়েক ঘণ্টা রাখার পর ডাক্তাররা জানান, তারা গুলি খুঁজে পাচ্ছেন না। এখানে অপারেশন হবে না। তারা পাঠান নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে। সেখান থেকে তারা জানান, সিট নেই। আর এই অপারেশন ওখানেও হবে না। পরে ৬ আগস্ট ভোরে আমার পরিবার আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। ৭ আগস্ট অপারেশন করে গুলি বের করা হয়। এরপর আবার অপারেশন হয় ২৫ আগস্ট। মেরুদণ্ডের হাড় গুঁড়াগুঁড়া হয়ে গেছে। সেগুলো বের করে সেখানে পাইপ ঢুকানো হয়েছে।’
হাবিব এ সময়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। একপর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘আমার এখন কি হবে? আমি কি কোনদিন সুস্থ হবো না? পারবো না স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে?’
ঢামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, তার পিঠে গুলি লাগায় স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নিচের অংশ অবশ হয়ে গেছে। এ কারণে হাবিব হাঁটাচলা করতে পারে না। তাকে বিদেশে চিকিৎসা করার জন্য সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। বিদেশে স্টেমসেল থেরাপি দিয়ে দেখা যেতে পারে। স্টেমসেল থেরাপি দিলে কখনো কাজ হয় আবার কখনো কাজ হয় না। এটা অনেক ব্যয়বহুল চিকিৎসা।