বাসস
  ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:১৬

আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে শহিদ ইয়াসির বলতেন, ‘তোমরা কি রাজাকার?’

প্রতিবেদন : সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন

ঢাকা, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : মায়ের স্নেহ আর ভালোবাসার মতো গভীর আবেগ ও বন্ধনও ইয়াসিরকেআন্দোলনে যোগ দেয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। মা চেয়েছিলেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে ছেলের জীবনে কোন প্রকার অপ্রীতিকর ও ক্ষতিকর ঘটনা না ঘটুক।  ছেলে বেঁচে থাক, আন্দোলনে না যাক। গভীর আবেগ ও ভালোবাসা দিয়ে সেই চেষ্টাই করেছিলেন মা বিলকিস আক্তার।

কিন্তু মো: ইয়াসির সরকার (১৮) মায়ের স্নেহের ডাক উপেক্ষা করেই ১৬ জুলাই থেকে প্রতিদিন রাজপথের প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন। গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনার পতনের পরে শহরের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষের সাথে ইয়াসিরওউল্লাস করেন এবং অবশেষে শহিদ হন ।

বিলকিস আক্তার তার পুত্র ইয়াসিরকে ছাত্র আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে তাকে আন্দোলনের সার্বিক পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করেন।

ছেলেকে তিনি বুঝিয়ে বলেন, ‘যারা শাহাদাত বরণ  করেন, তারা সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে চলে যান। কিন্তু তাদের বাবা-মায়ের অবস্থা কী হয়? তাদের সারা জীবন কতটা কষ্ট সহ্য করতে হয়, সেটাও ভেবে দেখো! ’

কিন্তু তার হৃদয়স্পর্শী প্রচেষ্টা বৃথা যায়। ইয়াসির তার মায়ের সব আবেদন উপেক্ষা করেইফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটাতে আন্দোলনে যোগ দেন।

গত ১৬ জুলাই রংপুরের আবু সাঈদের নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে ইয়াসির তার মায়ের আহ্বান উপেক্ষা করে সেদিন শনির আখড়া এলাকায় আন্দোলনে শরীক হন। এরপর শাহাদাত বরণের আগ পর্যন্ত তিনি নিয়মিত আন্দোলনে উপস্থিত থেকেছেন।

পরিবারের সদস্যরা ইয়াসিরের মৃত্যুর স্থান বা সময় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে তারা প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জেনেছেন, গত ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে যাত্রাবাড়ির কুতুবখালী এলাকায় পুলিশের গুলিতে ইয়াসির নিহত হন। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এ সংবাদ পেয়ে ইয়াসির তখন গণভবনের দিকে যাওয়ার জন্য মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।

তারা পরে একটি ভিডিওতে যাত্রাবাড়ি এলাকায় ইয়াসিরের লাশ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন।

আঠারো বছর বয়সী ইয়াসির নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজীনগর এমডব্লিউ কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি যাত্রাবাড়ির শনির আখড়া এলাকায় গ্যাস রোডের ব্যাংক টাওয়ারে পরিবারের সাথে বসবাস করতেন।

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ ইয়াসির।  বড় বোন বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিআইইউ) অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী হাফসা বুশরার সাথে তিনি আন্দোলনের গল্প করতেন ।

বাসস-এর সাথে আলাপকালে বুশরা বলেন, আমরা যখনই ওকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করতাম, ও আমাদের বলতো, ‘তোমরা কি রাজাকার?’ ওর কথা শুনে আমরা আর কিছু বলতে পারতাম না।

একদিন আন্দোলন থেকে বাড়ি ফেরার পর ইয়াসির রাস্তায় তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বর্ণনা করেন। তিনি জানান, লাঠি ও ইটপাটকেল নিয়ে আক্রমণকারীদের আসতে দেখে বিক্ষোভকারীরা যখন পিছু হটছিল, তখন তিনি অন্য একজনের সাথে তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা জবাব দেন। এতে আক্রমণকারীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

তার বড় ভাই মোঃ ইয়াকুব সরকার একটি সফটওয়্যার ফার্মে কাজ করেন। তিনি এই বীরত্বের গল্প শুনে ইয়াসিরকে বকাঝকা করেন এবং খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘তুমি কেন আন্দোলনে যোগ দিয়েছো?  তোমার এই রেজাল্ট নিয়ে তুমি কি সরকারি চাকরি পাইবা?’

তার জবাবে ইয়াসির বলেছিলো, ‘ভাইয়া  আমি চাকরির জন্য আন্দোলনে যাইনি। তুমি কি দেখোনি যে আমাদের অনেক ভাইকে রাস্তায় হত্যা করা হচ্ছে? আমি এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আন্দোলনে যোগ দিয়েছি।’ ইয়াকুব প্রতিউত্তরে ইয়াসিরকে আর কিছু বলতে পারেননি।

ইয়াসিরের শোকাহত মা জানান, ৪ আগস্ট দুপুরে ইয়াসির আহত হয়ে বাড়ি ফিরলে সেদিন তিনি তাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেন।

তিনি পুত্রের স্মৃতিচারণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি। গত ৫ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে সে কেবল এক গ্লাস পানি খেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। সেদিন সে সকালের নাস্তাও খায়নি।’

বিলকিস আক্তার বলেন, ‘আমার পাঁচ সন্তানের মধ্যে ইয়াসির ছিলো আলাদা। সে সবার খেয়াল রাখতো।’ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত মা এবং ক্যান্সার আক্রান্ত বাবাকে নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার কাজটি ইয়াসির নিজেই করতেন। তিনি বলেন, ‘সে সবসময় আমার পাশে থাকতো।’

তিনি এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমরা ভাবতেও পারিনি সে এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আমি এখনও তার অস্তিত্ব অনুভব করি। আমি সবসময় তার মুখ থেকে ‘মা’ ডাক শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি।’

তার বড় ভাই ইয়াকুব বলেন, ‘ ইয়াসিরের চেয়ে বড় হলেও আমরা যেন তারই ছায়ায় ছিলাম। সে আমাদের সবাইকে দেখে রাখতো। শিশু শ্রেণীর ছাত্রী আমাদের ছোট বোন নুসাইবাকে প্রতিদিন মাদ্রাসায় আনা-নেওয়ার কাজটিও ইয়াসিরই করতো।’

গত ৪ আগস্ট আন্দোলন নিয়ে ইয়াসির খুবই উত্তেজিত ছিল উল্লেখ করে বুশরা বলেন, পূর্ব নির্ধারিত ‘মার্চ টু ঢাকা’কর্মসূচি ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে জানার পর আনন্দ ও উত্তেজনায় ইয়াসির তার আঘাতের ব্যথা ভুলে গিয়েছিল।

সেই রাতে ইয়াসির খুব উচ্ছ¦সিত ছিল। সে তার বড় ভাইকে কৌতুক করে বলেছিল, ভাইয়া, চলো,  আব্বু, আম্মু, তুমি এবং আমিসহ সবাই আগামীকাল ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দেই। তোমরা যদি কর্মসূচিতে যোগ না দিয়ে বাসায় থাকো তাহলে সেনা সদস্যরা বাসায় এসে তোমাদেরকে আটক করবে।

গত ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মায়ের ডাকে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় আসার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন ইয়াসির। এমন সময় হঠাৎ করেই ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর তার মা তাকে বাড়ির পাশের একটি দোকান থেকে ময়দা ও চিনি আনতে বললে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার লক্ষ্যে জিনিসপত্র আনতে শনির আখড়ায় যান।
এদিন বিকেল ৫টার দিকে বড় ভাই ইয়াকুবের সঙ্গে ইয়াসিরের শেষ কথা হয়।

তার শোকাহত বড় বোন বুশরা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘দুপুর আড়াইটার দিকে যখন আমরা শুনলাম যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, তখন আমরা খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু আমার মন খুব অস্থির ছিল।’

সেসময় তার মা ইয়াসিরের সাথে যোগাযোগ করার জন্য বারবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এক পর্যায়ে বুশরা নিজেও ইয়াসিরকে ফোন করেন। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হন। বিকেল ৩টার পর থেকে তারা ইয়াসিরের ফোন বন্ধ পান, যা তাদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।

এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বুশরা তার ভাইয়ের খোঁজ চেয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। কিন্তু তার ভাইকে খুঁজতে অনেকে যখন তার কমেন্ট বক্সে মৃতদেহের ছবি পোস্ট করছিল তখন তিনি বিরক্ত হচ্ছিলেন।

রাত ১২ টার দিকে, একজন নারী ইয়াসিরের লাশের ছবি পোস্ট করে জানতে চান যে তিনি তার ভাই কিনা। বুশরা বলেন, ‘লোকেরা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করছিল যে আমার ভাই মৃতদেহের মধ্যে আছে কিনা, আমি তাদের কমনসেন্সের কথা ভেবে রেগে গিয়েছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘এমন মর্মান্তিক খবর শোনার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। কিছুক্ষণের জন্য আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে আমরা জানতে পারি ইয়াসিরের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।’

বুশরা জানান, ঢামেক হাসপাতালে পৌঁছানোর পর তারা তার দ্বিতীয় ভাই মাদ্রাসা শিক্ষক হাফেজ মোঃ ইয়াহিয়া সরকারকে দেখতে পান। তিনি ইয়াসিরের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। ইয়াসিরের ডান হাতে 'কালেমা তাইয়েবা' লেখা  ব্যান্ড বাঁধা ছিল।

ইয়াসিরকে কে বা কারা গুলি করেছে তা নিশ্চিত হতে না পারলেও বুশরা বলেন, তারা ইয়াসিরের শরীরে তিনটি গুলির চিহ্ন পেয়েছেন। দুটি ইয়াসিরের বুকের দুই পাশে বিদ্ধ হয়েছে এবং আরেকটি পিছন দিক থেকে তার মেরুদণ্ডের মাঝখানে আঘাত করেছে।

তিনটি  গুলির চিহ্ন দেখে শোকাহত বুশরা জানতে চান, ‘একজন মানুষকে হত্যা করতে কয়টি গুলি লাগে? একটি গুলিই কি যথেষ্ট নয়?’

তারা যখন অ্যাম্বুলেন্সে করে ইয়াসিরের মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন, তখন তারা একে অপরকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন যে, ইয়াসির জান্নাতে চলে গেছেন।

বুশরা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘কিন্তু বাস্তবতা হল তার মৃত্যু আমাদের হৃদয়কে ভেঙে দিয়েছিলো। যেহেতু  সে শাহাদাত বরণ করেছে, সে আর কখনোই আমাদের কাছে ফিরে আসবে না।আর আমরা সবাই মর্মান্তিক ভাবে তার অনুপস্থিতি অনুভব করছিলাম।’

ইয়াসিরের লাশ হস্তান্তরের বিষয়ে ঢামেক কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কথা উল্লেখ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোঃ ইউসুফ সরকার বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট থানার লিখিত অনুমতি ছাড়া পোস্টমর্টেম করা যায়না। ফলে পোস্টমর্টেম-এর  কারণ দেখিয়ে তারা ইয়াসিরের ডেথ সার্টিফিকেট দেয়নি।’

তিনি জানান, ওই দিন কোনো থানা চালু ছিল না। ফলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের অন্তত দুই থেকে তিন দিন অপেক্ষা করতে বলেন। পরে তারা ময়নাতদন্ত ও ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়াই লাশ গ্রহণ করেন।

ছোট পুত্রের স্মৃতিচারণ করে ইয়াসিরের বাবা মোঃ ইউসুফ বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছিলাম। ইয়াসির আমাকে ও তার মাকে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতো। শনির আখড়ায় আমার পোশাকের শোরুম চালাতেও সে আমাকে সাহায্য করতো।’

তিনি অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলেন, সে খুবই কর্মঠ এবং প্রাণবন্ত ছিল। ইয়াসিরের অনুপস্থিতিতে, আমাদের প্রাণবন্ত পরিবারটি একটি প্রাণহীন পরিবারে পরিণত হয়েছে। সে চলে যাওয়ায় আমাদের পরিবারকে এক অপূরণীয় শূন্যতা এবং নীরবতা গ্রাস করেছে।

ইয়াসিরের শোকাহত বাবা তার ছেলের হত্যার বিচার চান।তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত প্রত্যেক দায়ী ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’