শিরোনাম
প্রতিবেদন: সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন
ঢাকা, ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রিয় পুত্র মোঃ ইমরানকে হারিয়ে অন্তহীন বেদনায় স্তব্ধ মা জাহানারা বেগম।
স্থানীয়দের মধ্যে আলম বাবুর্চি নামে পরিচিত মো. আলম। তিনি জাহানারা বেগমের স্বামী, দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এ বছর ১৪ মে ইন্তেকাল করেন। তারপর থেকে ইমরানই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। মা আর ছোট বোন সানজিদা আক্তারকে নিয়ে কোনোরকমে চলছিলো তাদের সংসার। আট বছর আগে ইমরানের বড় বোন শামীমা আক্তারের বিয়ে হয়েছে।
ইমরান (২১) বাবার পেশায় বাবুর্চি হিসাবে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু ভাগ্য বিরূপ। গত ১৮ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় একটি বুলেটের আঘাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আর পরিবারটি হয়ে পড়ে অসহায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, গত ১৭ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজলা ও শনির আখড়াসহ যাত্রাবাড়ি এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেদিন সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। আর সেদিনই ইমরান গুলিবিদ্ধ হন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চূড়ান্ত রূপ নিলে ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন।
ভূমিহীন ও গৃহহীন মো. আলম যাত্রাবাড়ির কাজলা এলাকার রসুলপুরে বস্তির ভাড়া বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করছিলেন। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধান বাবুর্চি হিসেবে কাজ করে সংসার চালাতেন। ইমরানের শৈশব থেকে তারা এ বাড়িতেই ছিলেন।
মৃত্যুর আগে ইমরান ১ নভেম্বর থেকে বসবাসের জন্য একই এলাকায় দুই রুমের একটি ফ্ল্যাটের জন্য অগ্রিম টাকা দিয়েছিলেন। তার মা ও ছোট বোন এখন সেখানেই বসবাস করছেন।
তাদের বাসায় বসে বাসসের সাথে আলাপকালে ইমরানের শোকাতুরা মা জাহানারা বলেন, ‘আমার ছেলে মৃত্যুর আগে এই বাসার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়েছিলো। কিন্তু ভাগ্য তাকে এখানে থাকতে দেয়নি।’
ইমরানের ছোট বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু সানজিদা জানান, তার ভাই ১৫ জুলাই থেকে শিক্ষার্থীদের সাথে রাস্তায় আন্দোলনে যোগ দেয়।
তিনি বলেন, ‘আমার ভাই ১৫ জুলাই থেকে গোপনে আন্দোলনে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কখনই আমাদের কাছে বিষয়টি স্বীকার করেননি। ১৭ জুলাই বিকেলে তিনি আমাদের কিছু না বলে আন্দোলনে যোগ দিতে বাসা থেকে বেরিয়ে যান।’
সানজিদা জানান, তার মা আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে ইমরান বলেছিল, ‘চিন্তা করো না, আমার কিছুই হবে না।’
এদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজলা বাস স্টপেজ সংলগ্ন আদর্শ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে ছাত্র আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ইমরান অবস্থান করছিলেন। তখন পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে বিভিন্ন গলিতে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল।
সানজিদা বলেন, ‘আদর্শ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে আমার ভাই আমাকে ফোন করেন এবং পরিস্থিতি খুব খারাপ বলে আমাকে বাইরে যেতে নিষেধ করেন।’
সানজিদা জানান, প্রত্যক্ষদর্শীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ইমরানের সাথে কথা হওয়ার পরপরই পুলিশের ছোঁড়া একটি গুলি এসে তার মাথার ডান দিকে বিদ্ধ হয়।
তিনি আরো বলেন, ‘তবে ভাইয়া কোথায় ছিলো তা আমরা জানতাম না। অবশেষে, আমরা জানতে পারি যে এ কে স্কুল অ্যান্ড কলেজের কিছু ছাত্র আমার ভাইকে আহত অবস্থায় প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে রেফার করলে তারা তাকে ঢামেকে নিয়ে যায়।’
ঢামেক হাসপাতালে ১৭ জুলাই জরুরি ভিত্তিতে ইমরানের মাথায় অস্ত্রোপচার শেষে তাকে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়।
সানজিদা জানান, ইমরানের শারীরিক অবস্থার কোন উল্লেখযোগ্য উন্নতি না দেখে, ডাক্তাররা পরের দিন (১৮ জুলাই) বেলা ১ টার দিকে তাকে আরেকটি অস্ত্রোপচারের জন্য নিয়ে যান। কিন্তু অপারেশনের সময় তার হার্টে ব্লক পাওয়া যায়। তখন ডাক্তাররা অস্ত্রোপচার বন্ধ করে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখেন।
সানজিদা বলেন, ‘আমার ভাই লাইফ সাপোর্ট থেকে আর ফিরে আসেননি। ১৮ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
যাত্রাবাড়ি থানার পুলিশ তাদের সহযোগিতা না করায় পরিবারকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। হাসপাতাল থেকে লাশ ছাড়ার জন্য পাঁচ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।
সানজিদা বলেন, ‘পুলিশ যখন আমাদের সাহায্য করছিল না, তখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল কিভাবে আমরা লাশটি ছাড়িয়ে আনতে পারি। কারণ আমরা আমাদের নিজের হাতে ভাইকে দাফন করতে চেয়েছিলাম। আমরা জানতে পেরেছিলাম সে সময় অনেক লাশ গুম করা হচ্ছিলো।’
অবশেষে শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে ময়নাতদন্ত শেষে ২২ জুলাই লাশ গ্রহণ করেন তারা।
সানজিদা জানান, সে সময় যাত্রাবাড়ি এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করায় তারা রসুলপুর এলাকায় ইমরানের নামাজে জানাজার আয়োজন করতে পারেননি। তবে স্বজনদের শেষবার দেখানোর জন্য মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য সেখানে লাশ আনা হয়। ২২ জুলাই রাতেই নামাজে জানাজা শেষে ইমরানকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ছাত্র আন্দোলনকারীদের প্রতি ইমরানের সহানুভূতি সম্পর্কে সানজিদা বলেন, তার ভাই বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ‘অন্যায়’ পদক্ষেপের কথা বলতেন।
ইমরানের শোকাহত বোন বলেন, আমি তাকে বলেছিলাম, ‘এটাতো ছাত্রদের ব্যাপার, তোমার বিষয় নয়।’ তার উত্তরে সে বলেছিলো, ‘এটি একদিন আমাদের সবাইকে ভোগাবে।’ আমি যেহেতু নিজে একজন শিক্ষার্থী তাই আন্দোলনের প্রতি আমারও সমর্থন ছিলো। তাই আমি জোরালোভাবে বিরোধিতাও করিনি।
সানজিদা অশ্রু ভারাক্রান্ত স্বরে বলেন, ‘যেহেতু আমি তার পিঠাপিঠি ছোট বোন, তার স্মৃতি সবসময় আমাকে তাড়া করে। আমি তাকে ক্ষণিকের জন্যও ভুলতে পারি না।’
ইমরানের হত্যার প্রমাণ সম্পর্কে তিনি জানান, তাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। কারণ পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল বলে লোকজন ওই সময় কোনো ভিডিও ধারণ করতে পারেনি। এছাড়া কাজলা এলাকার বিভিন্ন অফিস ও প্রতিষ্ঠানের সিসিটিভি ক্যামেরার হার্ডডিস্ক জব্দ করেছে পুলিশ।
ইমরানের মা জাহানারা বেগমা জানান, ভালো জীবনযাপনের আশায় তিনি তার ছেলেকে বিদেশে চাকরির জন্য সৌদি আরবে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু, কোভিড -১৯ ইমরানের জন্য দুঃস্বপ্ন বয়ে এনেছিলো। মহামারীর কারণে ইমরান সেখানে একটি ভাল চাকরি যোগাড় করতে পারেনি।
তিনি জানান, সৌদিতে একটি ভাল চাকরি পাওয়ার জন্য সাড়ে চার বছর ধরে সংগ্রাম করার পর, ইমরান অবৈধভাবে জর্ডানে পাড়ি জমান। কিন্তু জর্ডানে পাড়ি জমানোর কয়েকদিন পর, সে দেশের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাকে অবৈধ প্রবেশের জন্য এ বছর ৭ জানুয়ারি দেশে পাঠিয়ে দেন।
ইমরানের শোকার্ত মা বলেন, দেশে ফেরার পর ইমরান তার বাবার সাথে বাবুর্চির কাজ শুরু করে। আমাদের আশ্রয় হিসেবে এক টুকরো জমিও নেই। তাই ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমার ছেলেকে আবারো বিদেশ পাঠাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় হলো না।’
ইমরানের মা দুঃখ ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলেন, আমার স্বামীর মৃত্যুর পর, আমার ছেলে ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
তিনি জানান, তার বাবার মৃত্যুর পর, ইমরান বাবুর্চি হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো। কিন্তু তাকে হারিয়ে আমাদের ভবিষ্যত এখন অনিশ্চিত।
সুদর্শন, দীর্ঘাঙ্গী এবং কঠোর পরিশ্রমী ইমরান বাবুর্চির কাজ না থাকলে রিকশা চালাতেন। জাহানারা বলেন, ‘আমার ছেলে কখনই বাড়িতে অলস বসে থাকতো না’।
এখন কীভাবে সংসার চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার ছোট মেয়ে এখন হতাশার সাগরে সাঁতার কাটছি। আমার বড় মেয়ের স্বামীসহ আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
ইমরানের মা অবশ্য জানিয়েছেন, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন তাদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।
জাহানারা কাঁদতে কাঁদতে তার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চেয়ে বলেন, ‘আমি শেখ হাসিনাকে ফাঁসির মঞ্চে দেখতে চাই’।