শিরোনাম
প্রতিবেদন : আবদুস সালাম আজাদ
চাঁদপুর, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বাবা কোথায়? বাবা কবে আসবে? মা, দাদা ও দাদীকে এমন প্রশ্ন করে অস্থির করে তোলে চার বছর বয়সী শিশু ইব্রাহিম। কিন্তু অবুঝ শিশুটির এসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না কেউ।
চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার গজরা ইউনিয়নের টরকী এওয়াজ গ্রামের রজ্জব আলীর ছেলে আরিফ হোসেন রাজিব (২৯)। গত ২০ জুলাই গাজীপুর বোর্ডবাজার আইইউটি গেট এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে পেটের নাভিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন তিনি। তারই অবুঝ শিশু পুত্র ইব্রাহিম। বাবাকে খোঁজে প্রতিনিয়ত।
এদিকে কেবল শিশু ইব্রাহিমই নন, স্ত্রীসহ পরিবারের সকলেই এখনও শোকাহত। ভুলতে পারছেন না শহিদ রাজিবকে।
সম্প্রতি সরেজমিনে রাজিবের বাড়িতে গিয়ে দেখাগেছে, জরাজীর্ণ ঘরের সামনে বসে আছেন পরিবারের সদস্যরা। আরিফের বাবা রজ্জব আলী পেশায় ছিলেন কৃষক। তবে গত কয়েক বছর আগে কাজে গিয়ে ডান হাত অকেজো হয়ে পড়ে। সে থেকে তিনি আর আর কোন রকম কাজকর্ম করতে পারেন না। মা আমেনা বেগম গৃহিণী।
কথা বলে জানা গেছে, রাজিবের ৪ বোন ২ ভাই । ভাই ও বোনদের মধ্যে রাজিব দ্বিতীয়। সবার বড় বোন মনি আক্তার (৩২), ছোট বোন নূরজাহান (২৬), মুক্তা (২৪) ও মীম (১৫)। মীম ছাড়া বাকি তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই শরীফ, বয়স ১৭। সে বোন মুক্তার সাথে গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতো। রাজিবের মৃত্যুর পর পরিবারের অনেকেই গ্রামের বাড়ীতে আছেন এখন।
রাজিবের বাবা-মা এক সময় পাশবর্তী কুমিল্লা জেলার হোমনায় থাকতেন। সেখানে আমেনা বেগম মানুষের বাড়িতে কাজ করে ছেলে-মেয়েদের বড় করেছেন। গত প্রায় এক যুগ পূর্বে চলে আসেন মতলবে নিজেদের বাড়িতে। বিয়ে হওয়া তিন মেয়ের পরিবারের অবস্থাও তেমন ভালো না, তারা কোনমতে নিজেরা কাজকর্ম করে চলে।
রাজিবের মৃত্যুর বর্ণনা দিলো ছোট বোন মুক্তা ও ভাই শরীফ। মুক্তা জানান, পোশাক কারখানায় কাজ করার কারণে গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা।
সেখানে গিয়ে রাজিব ভাঙারি দোকানে কাজ নেয়। দোকান মালিক থেকে টাকা নিয়ে ভাঙারি কিনে আনতো। তার আয়েই চলছিলো নিজের সহ বাবা-মার সংসার। ঘটনার দিন ২০ জুলাই বিকেলে কাউকে না জানিয়ে কাজ রেখে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যান তিনি। সেখানে আইইউটি গেটের সামনে ছাত্র-জনতার সাথে সংঘর্ষ হয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর। ওই স্থানেই পেটের নাভিতে গুলিবিদ্ধ হয় রাজিব। ভাইয়ের পরিচিত ফজলু নামে এক ব্যক্তি আমাকে ফোন দিয়ে জানায় যেরাজিব গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
ছোট ভাই শরীফ বলেন, ২০ জুলাই ভাই আমার সাথে ফোনে কথা বলেন। আমাকে বলেন তুমি কোথায়? আমি ভাইকে জানিয়েছি আন্দোলনের কারণে কারখানা বন্ধ। বাসায় চলে যাচ্ছি। আর কথা হয়নি। পরে জানতে পারি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। স্থানীয় গুটিয়া ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক ভাইকে মৃত ঘোষণা করেন।
শরীফ আরো বলেন, ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমরা ওই হাসপাতালে যাই। সেখান থেকে রাতেই ভাইয়ের মরদেহ নিয়ে আসি বাড়িতে। পরদিন সকালে এলাকায় নামাজে জানাজার পর স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করি।
ছোট বোন মুক্তা আরো বলেন, রাজিব গাজীপুর থাকাকালীন সময়ে গত প্রায় ৫বছর আগে নেত্রকোনা জেলার সদরের শাসনকান্দা এলাকার রাকিব মিয়ার মেয়ে শরীফাকে বিয়ে করে। স্ত্রীকে নিয়ে প্রথমে গ্রামের বাড়িতে থাকলেও ভাঙারি কাজে আয় রোজগার কম থাকায় গাজীপুরে আমাদের বাসার পাশে ভাড়া বাসায় চলে আসেন।
রাজিবের স্ত্রী শরীফা বেগম (২২) বলেন, তার বাবা রাকিব মিয়া (৫৫) পেশায় আইসক্রিম বিক্রেতা। মা নাছিমা আক্তার (৪০) গৃহিণী। ঘটনার দিন তার স্বামী রাজিব কাজে বের হয়ে যায়। এরপর আর কথা হয়নি। গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় প্রথমে আন্দোলন শুরু হয় ২০ জুলাই। ওইদিনই তিনি আন্দোলনে যান। সেখানে গিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন।
তিনি বলেন, আমি এখন এই অবুঝ সন্তান নিয়ে কিভাবে চলবো? তার জীবন তো পিতা ছাড়া অন্ধকার হয়ে গেলো। আমি আমার স্বামী হত্যার বিচারের পাশাপাশি আমাদের ভরণপোষণের জন্য সরকারি সহায়তা চাই।
রাজিবের বাবা রজ্জব আলী(৫৫) কথা কম বলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এবং ছেলেকে হারিয়ে তিনি শোকাহত। কারণ ছেলের আয় রোজগারে চলতো তাদের সংসার।
ছেলেকে হারিয়ে শোকাহত মা আমেনা বেগম (৫২)। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ছেলে আমার দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। ছোট বেলা থেকে রিকশা চালিয়ে সংসারের খরচ দিয়েছে।
এরপর এলাকায় ভাঙারি দোকানে কাজ করেছে। মেয়ে মুক্তার বিয়ের পরে গাজীপুরে চলে যায়। বিয়ের পর বউকে নিয়ে বাড়িতে ছিলো প্রায় দেড় বছর। আয় রোজগার কম হওয়ায় গাজীপুর যায়। কিছুদিন আগে আমার স্বামী গাজীপুর গেলে ছেলে আমার নাতিকে মাদ্রাসায় পড়ানোর জন্য অনুরোধ করে এবং নাতিকে দাদার হাতে তুলে দেয়। এই কথা গুলো আমাদের সকলকে ভীষণ ব্যথিত করে।
তিনি আরও বলেন, ছেলের মৃত্যুর পরে এলাকার লোকজনের সহযোগিতায় মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। রাজনৈতিক নেতারাও এসে খোঁজ খবর নিয়েছেন। কিন্তু কেউ আর্থিক সহযোগিতা করেনি। আমাদের কোন সামর্থ্য ছিল না ছেলের জন্য কোন আয়োজন করি। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নগদ ১০হাজার টাকা এবং কিছু ফল দিয়েগেছেন।
আমেনা বেগম বলেন, ছেলেকে হারিয়ে আমরা এখন দিশেহারা। ছেলের বউ, নাতি এবং আমার অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে কিভাবে সংসার চালাবো? ছোট ছেলে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে শহিদ ছেলের বউ ও নাতির জন্য সরকারি সহায়তা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা চাই।