শিরোনাম
প্রতিবেদন : বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : স্বপ্ন ছিল দুই মেয়েকে কষ্ট করে হলেও পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করার। কিন্তু আমার সেই স্বপ্ন ডুবতে বসেছে। পাশাপাশি ডুবতে বসেছে আমার পরিবার। আল্লাহই জানেন আমার ও পরিবারের ভাগ্যে কি আছে?
সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের ২২ নং শয্যায় বসে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমন কথা বলেন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ মোশাররফ হোসেন (৪০)।
তিনি বলেন, ‘এখন আমার কোন আয় নেই। বাবা মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে যা পান তা দিয়েই কোন মতে সংসার চলছে। আমার পায়ের সঙ্গে যেন পুরো পরিবারও পঙ্গু হয়ে গেছে। সাত জন মানুষের সংসার এই সময়ে কিভাবে চলবে? ঢাকা মেডিকেলে আসার আগে জমানো প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। সরকার এক লাখ টাকা দিয়েছে, তাতে কিছুই হয়নি।
মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমি চাই আমার পা ঠিক হোক। আমি যেন কাজ করে খেতে পারি। ১ লাখ, ৫ লাখ টাকা দিল, এতে তো আমার মন ভরবে না। আমি তো আরও চাইব। কিন্তু এটা আমার চাওয়া না। আমার চাওয়া পা যাতে ঠিক হয়ে যায়। আমি যেন নিজে পরিশ্রম করে খেতে পারি। মেয়ে দুইটারে মানুষের মত মানুষ করতে পারি। পুরো পরিবার নিয়ে যেন কোন ভাবে খেয়ে পরে বাঁচতে পারি।’
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পরে রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। এ সময় বিজয় মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ, যুবলীগের সন্ত্রাসীরা। তারা নানাদিক থেকে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের ওপর হামলা চালায়।
মোশাররফ হোসেনও বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে মাওনা চৌরাস্তার সামনে গুলিতে আহত হন। এখন তিনি রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মোশাররফ দুই পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে বেডে শুয়ে আছেন। প্রচন্ড ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন। দুই পায়ে গুলি লাগলেও, তার ডান পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। তবে সর্বশেষ চিকিৎসকরা ড্রেসিং করে ক্ষত স্থানে সেলাই করেছেন। পাশেই বসে মাথায় হাতবুলিয়ে দিচ্ছেন তার স্ত্রী রহিমা বেগম (৩৫)।
মোশাররফ হোসেনের বাড়ী ময়মনসিংহের গৌরীপুরের শালীহর গ্রামে। তার বাবা মো. নাজিমউদ্দিন (৬৫) এবং মা নূরজাহান বেগম (৫৫)। সংসারে দুই মেয়ে ও স্ত্রী ছাড়াও রয়েছেন বাবা-মা ও বোন। মোশাররফের আয়ের ওপরই চলত সাতজনের ভরণপোষণ। বোনকে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে তিনিও বাবার বাড়িতে থাকেন।
বাবা গ্রামের বাড়িতে স্থানীয় এক মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। শুরু থেকেই মোশাররফ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন।
গার্মেন্টসকর্মী হয়েও এই আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার দুটি মেয়ে আছে। তারা লেখাপড়া করে। তাদের কথা চিন্তা করে আন্দোলনে যোগ দিই।
তাদেরও তো এমন সময় আসতে পারে।’
মোশাররফের বড় মেয়ে শারমিন আক্তার মিম (৮) মাওনায় একটি মাদ্রাসায় পড়ছিল। বাবা আহত হওয়ার পর যাতে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে না যায় সে জন্য তাকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। ছোট মেয়ে জিনিয়া আক্তার মিমের বয়স আড়াই বছর।
সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে মোশাররফ হোসেন বলেন, সেদিন ছিল ৫ আগস্ট। আমি মাওনা চৌরাস্তার সামনে বিজয় মিছিলে ছিলাম। সৌখিন ও এনা পরিবহনের দুটির বাস ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। পরে বাস দুইটির গতিরোধ করে ছাত্র-জনতা। এ সময় বাসে থাকা অস্ত্রধারীরা গুলি চালানো শুরু করে। তাদের গুলি এসে আমার পায়ে লাগে। বিকেল ৪টার দিকে আমার পায়ে গুলি লাগে। তার আগেই দুপুরে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মোশাররফ বার্ন ইন্সটিটিউটের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলেন, ‘গুলি লাগার পর ছাত্র ভাইদের বললাম পায়ে গুলি লেগেছে। তারা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। ঢাকায় ঢোকার সুযোগ ছিল না। শেখ হাসিনা যাওয়ার পরও ছাত্রলীগ তাণ্ডব চালাচ্ছিল। ময়মনসিংহ হাসপাতালে ঢোকার ১০ মিনিট পরই শুনতে পাই, গেটে ছাত্রলীগ ঝামেলা করেছে। কোনো লাশও ঢুকতে দিচ্ছে না। হাসপাতালে ঢোকার পর চোখের সামনেই একটা ছেলের মৃত্যু হয়। আধা ঘণ্টা পর দেখি লাশ আসছে। জানতে পারি ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী কাউকে পেলেই কুপিয়ে হত্যা করছে। আমার এক পাশ থেকে রক্ত বের হচ্ছিল, আর অন্যদিকে চলছিল স্যালাইন । পরে চিকিৎসকরা ড্রেসিং করে সেলাই করে দেন।
মোশাররফ বলেন, ১৩ আগস্ট ময়মনসিংহ থেকে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে ভাসকুলার ডিজিজ হাসপাতালে আমাকে রেফার করা হয়। গত ১৯ আগস্ট সেখান থেকে আবার রেফার করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক)। সেই থেকে আমি এখনো ঢামেকে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে দুবার অপারেশন হয়েছে। রক্তনালি জোড়া দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু দুই দিন পর আবার ছুটে যায়। ভেতরে ইনফেকশনও হয়ে যায়। ডাক্তার জানিয়েছেন ড্রেসিং করে রাখতে হবে। শুনেছি চিকিৎসার জন্য আমাকে বিদেশ পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, গার্মেন্টেসে চাকুির করে সব কিছু মিলিয়ে ২০-২২ হাজার টাকা বেতন পেতাম। তাতেই সবার চলত। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে মাওনা থাকতাম। বাবা-মা আর বোন গ্রামে থাকেন। এখন আমি আহত, চাকুরি নাই, আব্বার সামান্য কিছু আয়ে চলে আমাদের পুরো সংসার। মেয়ে দুইটাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার অনেক ইচ্ছ ছিল কিন্তু কি হবে জানি না। দোয়া করবেন ভাই, আমি যেন সুস্থ হতেপারি, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারি।
ঢামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, মোশাররফের ডান পায়ের ঊরুতে গুলি লেগেছে। এতে পায়ের প্রধান রক্তনালি ছিঁড়ে গেছে। আমাদের এখানে তাকে কৃত্রিম রক্তনালি দিয়ে গ্রাফ করা হয়। গ্রাফ করে প্রাইমারি কাজ চালু করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এই গ্রাফটা টেকেনি। রক্তনালি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটা কমিটি গঠন করা হয়। তারা তার বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এই রোগীর বিষয়ে অমরা আমাদের সাধ্য মত চেষ্টা করছি।
সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে পাঠানোর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে মোশাররফ বলেন, ‘আমার পাসপোর্ট তৈরির জন্য সকল কাগজ পত্র নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার এনআইডিতে একটু সমস্য আছে, তাই পাসপোর্ট হচ্ছে না। তারা চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছে।’
দেশবাসীরকাছে দোয়া চেয়ে মোশাররফের স্ত্রী রহিমা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামীর জন্য দোয়া করবেন। সে যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। তার অনেক স্বপ্ন মেয়ে দুইটাকে লেখাপাড়া শেখানোর। আমাদের যেন কারো কাছে হাত পাততে না হয়। আমার স্বামী যেন কাজ করে খেতে পারেন।’