বাসস
  ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩৬
আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:৩৬

স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনে বাড়ি আর ফেরা হল না শহিদ রাকিবের

প্রতিবেদন : মো. আব্দুল কাইয়ুম

ময়মনসিংহ, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : অন্তঃস্বত্ত্বা ও অসুস্থ স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনতে গিয়েছিলেন রাকিব। কিন্তু ওষুধ নিয়ে আর ফিরলেন না তিনি। ফিরে এলো তার লাশ।

ময়মনসিংহে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদ হন কোরআনে হাফেজ নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিব (২১)। নববধূ স্ত্রী সাদিয়া আক্তারের হাতের মেহেদি মুছার আগেই শহিদের স্ত্রী হিসেবে মর্যাদা পেলেন তিনি। কিন্ত অনাগত সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে দুঃশ্চিন্তা যেন পিছু ছাড়ছে না সাদিয়ার। অপরদিকে নববধূ সাদিয়ার ভবিষ্যত নিয়েও চিন্তিত গোটা পরিবার।

শহিদ রাকিবের স্ত্রী সাদিয়া আক্তার জানান, বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। যেকারণে  ২০ জুলাই সকালে তার জন্য ওষুধ আনতে গৌরীপুরের কলতাপাড়া বাজারে গিয়েছিলেন রাকিব। তখন কলতাপাড়া বাজারে ছাত্র-জনতার সাথে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী ও পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল। এ সময়ে তিনি মোবাইলে ভিডিও ধারণ করছিলেন। আর তখনই পুলিশের গুলিতে নিহত হন রাকিব।

তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরও বলেন, সংসারের হাল ধরার মতো রাকিব ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই।

রাকিবের মা নুরুন নাহার। তার বয়স ৫৬। তিনি ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। সেখান থেকে রাতে ফিরে তিনি আর ছেলের মুখ দেখতে পাননি।

রাকিবের বাবা আব্দুল হালিম (৬২)ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার দাওগাঁও তালিমুল কুরআন মহিলা মাদ্রাসার পরিচালক ও শিক্ষক।

তিনি জানান, ছেলের মৃত্যুর পর পুরো পরিবার লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। অনাগত অতিথির জন্য তিনি উদ্বিগ্ন। সাদিয়া ও তার গর্ভে থাকা সন্তানের কী হবে, কী করবেন বা কী করা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।

তিনি বলেন, ‘স্বামী শোকে পাথর হয়ে গেছে সাদিয়া। সারাদিনই কান্নাকাটি করে, ওর মুখের দিকে তাকানোই যায় না। দেখলেই কলিজাটা খান খান করে হয়ে যায়।’

রাকিবের বাবা আরও জানান, চার ভাইবোনের মধ্যে রাকিব ছিলেন তাঁর একমাত্র ছেলে সন্তান। তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে মাদরাসায় পড়ছেন।

চলতি বছরের ১২ জানুয়ারী রাকিবকে বিয়ে করান পার্শ্ববর্তী ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার তারুন্দিয়া ইউনিয়নের পলাশকান্দা গ্রামে। পুত্রবধূ সাদিয়া আক্তারও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। সে সাত মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। রাকিবের কণ্ঠস্বর খুবই ভালো ছিল। ভিডিও করা তাঁর শখ ছিল। তাঁর ফেসবুক আইডি আছে। সেখানে গজল গেয়ে আপলোড করতো। অনেক আশা ছিল রাকিব সংসারের হাল ধরবে। বংশের বাতি হয়ে আলোকিত করবে। এখনতো সবই শেষ হয়ে গেলো। বংশের বাতিটাইতো নিভে গেলো।

তিনি আরও জানান, ঘটনার দিন রাকিবের মাকে নিয়ে তিনি এক আত্মীয়ের বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আত্মীয় বাড়িতে থাকাবস্থাতেই রাকিব গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পান তিনি। রাকিবের বুকের বাম দিকে ছিদ্র ছিল। রাকিব গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এমন খবর পেয়ে তার মা সাথে সাথেই জ্ঞান হারান। তাকে হাসপতালে নিয়ে যাওয়া হলে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার ভর্তি করার পরামর্শ দেন। এদিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার কারণে রাকিবের মরদেহ দাফনের ব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল আল আমিন জনি দ্রুত দাফন করতে নির্দেশ দেন। এমনকি জানাজার জন্যে মাইকিং করতেও বারণ করেন তিনি। এদিকে ইউপি চেয়ারম্যানের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুতই রাকিবের জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। রাত দশটার দিকে রাকিবের মা হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন ছেলের মরদেহ দাফন হয়ে গেছে।

রাকিবের বাবা আক্ষেপ করে বলেন, ‘ছেলেকে হাফেজ বানিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমার মৃত্যুর পর ছেলে জানাজা পড়াবে। ছেলের কাঁধে চড়ে কবরে যাবো। কিন্তু পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কত কষ্টের এটা আমার মতো হতভাগ্য পিতা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না।’