বাসস
  ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪১
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০৫

শোক আর অনিশ্চয়তায় দিশেহারা শহিদ রানার পরিবার

প্রতিবেদন: সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন

ঢাকা, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস): একদিকে প্রিয়জন হারানোর বেদনা অন্যদিকে খাওয়া-পরার অনিশ্চয়তা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে শোক আর হতাশায় ডুবে গেছে শহিদ মো. রানার পরিবার। মা হারিয়েছেন তার একমাত্র পুত্রকে। স্ত্রী হারিয়েছেন স্বামী। আর পাঁচ বছর বয়সি বাচ্চাটি হারিয়েছে তার বাবাকে। পাঁচ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি রানার অনুপস্থিতিতে তারা একই সাথে মানসিক ও অর্থকষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।   

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট দুপুরে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ঘটে। এরপর নগরীর যাত্রাবাড়ি এলাকায় বিজয় মিছিলে যোগ দেন রানা (৩০)। এ সময়ে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন তিনি। 

পাঁচ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি রানা সেদিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে যাত্রাবাড়ীর শেখদী এলাকার বাসা থেকে বের হয়ে যান। পথে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে হাজার হাজার মানুষের সাথে তিনিও আনন্দ মিছিলে যোগ দেন। 

পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ‘শত শত আন্দোলনকারীদের সাথে রানা যখন বিকেল ৪টার দিকে যাত্রাবাড়ি থানা এলাকায় পৌঁছান, তখন তার মাথার পেছনে গুলি লাগে এবং বুলেটটি ভেতরে আটকে যায়। সে সময় পুলিশ রাস্তায় উল্লসিত জনতাকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল।’

সেদিনের একটি ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ি থানা থেকে পুলিশ বাহিনী বেরিয়ে আসছে এবং রাস্তায় উচ্ছ্বসিত জনতার ওপর পাখির মতো গুলি করছে। এতে অনেক লোক নিহত হয়।

রানার মৃত্যুর পর থেকে পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়েছে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তার মা স্বপ্না আক্তার (৫০), স্ত্রী লাকী আক্তার জোনাকি (২৪), স্থানীয় মাদ্রাসায় প্রথম শ্রেণীর ছাত্র একমাত্র ছেলে জুনায়েদ হোসেন ইফরান (৫), কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী ছোট বোন শারমিন আক্তার চোখে অন্ধকার দেখছেন। 

সম্প্রতি তাদের শেখদীর বাসায় বাসসের সাথে এক সাক্ষাৎকারে রানার শোকার্ত বোন শারমিন আক্তার বলেন, ‘তিন ভাইবোনের মধ্যে রানা আমাদের একমাত্র ভাই ছিল। আমার বড় বোন সুমি আক্তারের বিয়ে হয়েছে কয়েক বছর আগে। আমাদের বাবা শাহাব উদ্দিন ২০১৫ সালে মারা যাওয়ার পর থেকে রানা আমাদের পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য এবং অভিভাবক ছিলেন। তিনি বাসে কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করে আমাদের ভরণ-পোষণের যোগান দিতেন। কিন্তু  তার আকস্মিক মৃত্যুতে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি।’

শারমিন কান্না ভারাক্রান্ত স্বরে বলেন, ‘আন্দোলন শুরুর মাঝামাঝি সময় থেকে রানা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পরিবারের সদস্যদের সাথে আন্দোলনে অংশগ্রহণের বিষয়ে কখনো কথা বলেননি। এই আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ১৬ বছরের  স্বৈরাচারী শাসনের অবসান হয়েছে, কিন্তু আমরা তো ভাইকে হারিয়েছি। আমার ভাই আর বাড়ি ফেরেনি।’

তিনি জানান, ওই দিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তার মামা (মামা) মো: ইসমাইল হোসেন তাকে ফোন করে বলেন, যাত্রাবাড়ী এলাকায় রানা মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে কেউ তাকে ফোনে জানিয়েছে।

উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবেই রানা মারা গিয়েছে অভিযোগ করে তার ছোট বোন শারমিন বলেন, ‘আমরা জানি না কে ফোন করেছিল। তবে খবর শুনে আমার মা এবং আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই এবং আমার ভাইকে জীবিত দেখতে পাই। তারপর আমরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু সেদিন কোন ডাক্তার না থাকায় আমার ভাই হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা পায়নি।’

তিনি বলেন, ‘পরে আমরা আমার ভাইকে মতিঝিলের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে যাই। আমরা হাসপাতালে ঢোকার সাথে সাথে রাত সোয়া ৮টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক রানাকে মৃত ঘোষণা করেও হয়তো ফিরতে পারেন এ আশায় ৬ আগস্ট সকাল পর্যন্ত তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখেন।’

পরে তারা হাসপাতাল থেকে মরদেহ গ্রহণ করে ওই দিনই মাতুয়াইল কবরস্থানে রানাকে দাফন করেন।

শারমিন আবেগাপ্লুত কন্ঠে বলেন, ‘তবে, ৬ আগস্ট সকালে আমরা জানতে পারি যে আমাদের ধারণা ভুল ছিল।  এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা আমাদের মেনে নিতে হবে যে, আমার ভাই আমাদের চিরতরে ছেড়ে চলে গেছে এবং আমরা একমাত্র অবলম্বন হারিয়েছি!’

জানা যায়, রানার ছোট বোন শারমিন এবং স্ত্রী লাকি তাদের জীবন ধারণের জন্য ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। তারা বাড়ি থেকে থ্রি-পিস সালোয়ার কামিজ ও সিরামিক পণ্য বিক্রি শুরু করেছেন। 

শারমিন বলেন, ‘সংসারের ব্যয় মেটানোর কোনো উপায় না থাকায়, ভাবী (রানার স্ত্রী) এবং আমি খুব অল্প পুঁজিতে পুরাতন কাপড় যেমন থ্রি-পিস এবং সিরামিক পণ্য বিক্রি করছি।’

তারা এক মাসে প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারেন। যেখানে তাদের বাড়ি ভাড়াই ৮ হাজার টাকা দিতে হয় সেখানে এটি খুবই সামান্য আয়। 

শারমিন বলেন, ‘আমার ভাইয়ের মৃত্যু আমাদের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তার মৃত্যুর পর থেকে আমরা তীব্র অর্থ কষ্টে দিন কাটাচ্ছি।’

তিনি জানান, তারা শুধুমাত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে ২ লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছেন।

নোয়াখালী সদর উপজেলার মাইজদীর অধিবাসী এই পরিবারটির গ্রামে কোনো জমি বা বাড়ি না থাকায় তাদের ঢাকার ভাড়া বাসায় থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই।

শারমিন বলেন, আমার বাবা দীর্ঘদিন ধরে শেখদী এলাকায় রিকশাচালক ছিলেন। তাই আমার ভাইবোনদের সকলের জন্ম ঢাকায়। 

রানার আকস্মিক মৃত্যুতে শারমিনের পড়াশোনা নিয়েও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। রানা তার শিক্ষার সব খরচ বহন করতেন। তিনি ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলেন, ‘আমি জানি না পড়াশুনা আর চালিয়ে যেতে পারব কি না।’

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহিদদের তালিকায় তার ভাইয়ের নাম আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে জানি না, আবেদন করতেও জানি না। যেহেতু আমাদের পরিবারে কোনো পুরুষ নেই, আমাদের বাইরে যাওয়া খুব কঠিন।’

রানার স্ত্রী শোকস্তব্ধ লাকি বাসসের সাথে কথা বলতে খুব লজ্জা পাচ্ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি সংক্ষেপে তার যন্ত্রণার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীই আমাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল। তার মৃত্যুতে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। এত কম বয়সে স্বামীকে হারিয়ে আমি দু’চোখে অন্ধকার দেখছি।’

তিনি তার ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে পড়ালেখার খরচ বহন করার জন্য সরকারের কাছে সহযোগিতা চান। 

কাঁদতে কাঁদতে লাকি বলেন, ‘আমার পাঁচ বছর বয়সী ছেলেই এখন আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। আমার ছেলেকে দেশের একজন আলোকিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন।’

রানার মৃত্যুর সাথে সাথে তার স্মৃতিবিজড়িত পরিবারের সকল ছবি এবং ভিডিও হারানোর জন্যও গভীর দুঃখ প্রকাশ করে শারমিন বলেন, ‘আমার ভাইয়ের সাথে থাকা স্মার্টফোনটি কেউ চুরি করেছে। আমরা তার সব স্মৃতি এবং পারিবারিক ছবি হারিয়ে ফেলেছি!’

ফুফু ও মাকে বাবার সম্পর্কে কথা বলতে দেখে রানার ছেলে জুনায়েদ হোসেন ইফরান এই প্রতিবেদকের কাছে এসে বলেন, ‘চাচা, আপনি কি জানেন? আমার বাবা খুব ভালো ছিলো। আমাকে আর আমার চাচাতো ভাইদের চকলেট, চিপস, জামাকাপড় ও বিস্কুটসহ অনেক কিছু কিনো দিতো। আমি বাবাকে খুব মিস করি।’

রানাকে যারা হত্যা করেছে তাদের ফাঁসির দাবি জানিয়েছে তার পরিবার।