বাসস
  ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৫
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:৫৬

শহিদ রানা আর কোনদিন ফোন করে জানতে চাইবে না,‘বাবু কি করে’, ‘তোমরা খেয়েছো’?

প্রতিবেদন : ইসমাঈল আহসান

ঢাকা, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস): গত ৫ আগস্ট দুপুর। টিভিতে হাসিনার পতনের সংবাদ দেখে উচ্ছ্বসিত রানা তাঁর মা’কে বলেছিলেন, ‘মা, আমাদের দুঃখের দিন শেষ। আর তোমাকে মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করতে হবে না।’ 

এই কথা বলে বিকেলে বিজয় মিছিলে শরীক হন তিনি। সেখানে উত্তরা পূর্ব থানার সামনে পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান রানা তালুকদার (৩২)।
ঘটনার বর্ণনায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাঁর মা রুবি বেগম (৬০) বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলা থেকে কষ্ট পেয়ে বড় হয়েছে। ওর বাবা মারা গেছে ওর পাঁচ বছরের সময়। আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করে অনেক কষ্টে ওদের মানুষ করেছি। মনে করেন যে, এখন একটু সুখের মুখ দেখছিলাম। রানা একমাস হয় নাই তার একমাত্র বোনকে বিয়ে দিয়েছে। তিন লাখ টাকা ঋণ করেছে এ বিয়ে দিতে গিয়ে। ওর বড় ভাইটা কোন কাজ করতে পারে না, মানসিকভাবে অসুস্থ। যুদ্ধ শুরু হইলো আর ও ড্রাইভিং এর একটা চাকরি পাইলো।’ 

রাষ্ট্রীয় সাংবাদ সংস্থা বাসসকে তিনি বলতে থাকেন, দুপুরবেলা ওকে নিয়ে একসাথে ভাত খাইছি। খেতে খেতে খবর দেখে বলে, ‘মা আমি কাজ কইরা আনমু। তোমরা খালি বইসা বইসা খাইবা।’ হেই ছেলে মনে করেন যে আসরের নামাজ পইড়া বাইর হইছে। সন্ধ্যা হয়া যায়, ছেলে আমার আসে না। বউ বলে, মা একটু খোঁজ নিয়া দ্যাখেন না? পরে আমি আর বড় ছেলের বউ দু’জনে বাইর হইছি ওদের দুই ভাইকে খুঁজতে। রানায় ফোন ধরে না। ওর বড় ভাইরে ফোন দিছি। সে বলে আমরা পূর্ব থানার পাশে। বড় ছেলে আগের থেকেই ওখানে ছিল। ছোট পোলায় আসরের পরে ওইখানে গিয়ে বড় ভাইয়ের সাথে মিলিত হইছে। আমরা দুইজনে ওদের খুঁজতে খুঁজতে থানার পিছনে গিয়ে উপস্থিত হই। সেখানে অনেক আগুন জ্বলতাছে। সামনে আর আগানো যায় না। আমি কই, তোমার ভাই কই? হ্যায় কয়, আমার ভাই আমার লগেই আছে। আমি বলি, ওরে ডাইকা আনো। বাচ্চায় কানতাছে, অর বউ কানতাছে। 

দক্ষিণখানের দক্ষিণ আজমপুর জামতলার ভাড়া বাসায় বসে তিনি এ প্রতিবেদককে আরো বলেন, আমার পীড়াপীড়িতে তারপরে সে আসছে। থানার সামনে থিকা পিছনে আমার বগলে (কাছে) আসছে। পরে আমি হাতটা ধরছি। ধইরা বলতেছি, চলো বাসায় চলো। সে বলে, না মা আমার বড় ভাই আছে। তারে নিয়া আসি। বইলা যেইমাত্র সেক্টরের গেটটা পার হইছে, অমনে তিন-চারটা গুলি আইসা তার মাথার মধ্যে লাগছে। তার বড় ভাই দৌড়ে এসে বলতেছে, ‘মা আমার ভাই নাই।’ সাথে সাথে দৌড়াইয়া যাইয়া দেখি, গেটের সামনে সোনা আমার উপুড় হয়া পইড়া আছে। মাথার মধ্যে ধরছি, গরম রক্ত। মাথার ভিতরে হাত ঢুকে গেছে গুলির জখম দিয়া। দেখি আমার ছেলে আর নাইক্কা। 

তিনি বলেন, তাড়াতাড়ি একজনের কাছ থেকে গামছা নিয়া মাথার মধ্যে বাইন্ধা ধরাধরি কইরা বাংলাদেশ মেডিকেল নিয়া গেছি। ছেলে আমার ঐখানেই শেষ। তাইলে বলেন, মায়ের মনে কেমনে মানায়?

টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর উপজেলার যুগীহাটি গ্রামের মৃত সিরাজুল তালুকদারের ছিল দুই ছেলে ও এক মেয়ের সংসার। পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারান শহিদ রানা তালুকদার। একমাত্র বড় ভাই রনি তালুকদার। তাদের পুরো জীবনটাই সংগ্রামে কেটে গেল। সুখের মুখ আর দেখা হলো না। শেষ পর্যন্ত জীবন যুদ্ধের কাছে হার মেনে এখন তিনি শুয়ে আছেন দক্ষিণখানের স্থানীয় গণ কবরস্থানে। বন্ধুরা তাঁর কবরটাকে লাল সবুজের পতাকা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে। কবরস্থানে আগত জিয়ারতকারীরা তাঁর কবরটা দেখে আর চোখ মোছে। এলাকাবাসীসহ সবার মুখে একটাই কথা, বিজয়ের পরে কেন উত্তরায় এতগুলো মানুষ শহিদ হলো?

‘জুলাই রেভ্যুলুশনারী অ্যালায়েন্স’ এর তথ্য মতে শুধুমাত্র উত্তরায় পাঁচ আগস্ট বিজয়ের পরে নিরাপত্তা বাহিনীর এলোপাথাড়ি গুলিতে অর্ধশতাধিক মানুষ শহিদ হয়েছেন এবং গুলিবিদ্ধ হয়েছেন কয়েকশ। আর পুরো আন্দোলনে উত্তরায় শহিদের সংখ্যা শতাধিক। 

তাদের মতে, এই সংখ্যা আরো বাড়বে। কারণ অসংখ্য লাশ গুম করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। এটা নিয়ে তাঁরা ব্যাপক ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছেন মাঠ পর্যায়ে। জানালেন এ প্রতিষ্ঠানের আহবায়ক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সালেহ মাহমুদ রায়হান। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘এ ধরনের কাজগুলো করার কথা ছিল প্রশাসনের বা রাষ্ট্রের। কিন্তু উত্তরার প্রশাসন একেবারে হাত গুটিয়ে বসে আছে। আমরা কাজগুলো করছি তাও কোনো রকম সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই। সরকার বা সরকারি কোন সংস্থার কাছ থেকে ন্যূনতম কোনরকম সহযোগিতা আমরা পাইনি।’

এদিকে লক্ষ্মীপুরের মেয়ে রানার বৌ রানু (২৪) বলেন, ‘সকাল থেকে সে বাসায় ছিল। ছেলের সাথে সময় কাটাইছে। হয়তো উনি মৃত্যুটা টের পেয়েছেন। সকাল বেলায় ছেলেটাকে একটু শাসন করছি। হাল্কা মাইর দিছি। ছেলেকে বলছি, এতো জ্বালাও কেন? তখন রানা আমাকে বলেছে, আমরা যেরকম পিতার অভাবে লাথি-উষ্টা খেয়ে বড় হয়েছি। এখন আমি যদি মরে যাই, তাহলে আমার সন্তানকেও এরকম লাথি-উষ্টা খেতে হবে।

আড়াই বছরের একমাত্র সন্তান মেহেরাজ তালুকদার। অবুঝ শিশুটা বোঝেই না তার বাবা আর নাই। কিন্তু বাবার লাশ, বাবার রক্ত, গুলি সবই নিজের চোখে দেখছে। ও শুধু একটা কথাই বলে, বাবা মারা গেছে। এ কথাটা বললে একটা মায়ের কাছে কতটা কষ্টের? বড় হয়ে ও যখন বলবে, আমার বাবা কৈ? কি উত্তর দেয়া হবে তাকে? 

রানু বলেন, এই বয়সে আমার সন্তানটা বাপ ছাড়া হয়ে গেছে। বাপের আদর থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছে। ডিউটিতে থাকার সময় সে কতবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতো, বাবু কি করে? মা কি করে? তোমরা দুপুরে খাইছো? ওই নাম্বার থেকে আর তো ফোন আসে না, ৫ আগস্টের পর থেকে....কোনদিন আসবেও না জানি। এখন কেমনে মনেরে বোঝাই?

বিয়ের নয় বছর পরে এই সন্তানটা হয়েছে। কত আদরের ধন! এত স্বপ্ন, এত সাধনার ছেলে। কত শখ ছিল যে পোলাডারে হাফেজি পড়ামু। 

সে বলতো, ‘টাকার অভাবে আমরা লেখাপড়া করতে পারি নাই। এতদিন পর আল্লাহ আমাদেরকে যেহেতু একটা সন্তান দিয়েছেন। তাই সন্তানকে আমি আল্লাহর রাস্তায় নিয়া যামু। ওরে কুরআন পড়ামু। ছেলেরে মানুষ করমু। হুজুর হয় যেন সে...। ছেলেকে রেখে সে কোথায় পড়ে আছে? ঢাকা শহরে আমাদের আপন বলতে কেউ নাই। আমরা এখন কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো?‘

সদ্য বিয়ে হওয়া একমাত্র বোন আকলিমা (২০)। এক প্রকার বোবা হয়ে গেছে সে। তার মা অনেকবার বললেন, তুমি কিছু বলো। কোনভাবেই আমাদের সামনে সে আর আসলো না।

সরকারি/বেসরকারি কোনরকম সহযোগিতা পেয়েছেন কি না? এরকম প্রশ্নের উত্তরে শহিদের মা বলেন, জামায়াতে ইসলামী থেকে দেড় লক্ষ টাকা এবং আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে এক লক্ষ টাকা আমরা পেয়েছি। সরকারি কোনো অনুদান বা খোঁজ-খবর, কিচ্ছু আমরা পাইনি।

শহিদ রানার মা সরকারের কাছে আবেদন করে বলেন, ‘এই পোলাডা, ছোট মাসুম বাচ্চা। পুরাডা জীবন অর আর অর মায়ের পইরা রইছে। স্বামী ছাড়া একা সংগ্রাম কইরা এই পর্যন্ত আইছি। আর যে পারি না। এখন এই বৃদ্ধ বয়সে অগো লইয়া আমি কী করমু, বাবা কইতে পারো?’