বাসস
  ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:০৬
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:৫০

মা ডাক আর শোনা হলো না সুমাইয়ার

প্রতিবেদন : নুসরাত সুপ্তি

নারায়ণগঞ্জ, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : চারিদিকে গোলাগুলির শব্দ পাইতাছিলাম সেদিন, একটু পর পর হেলিকপ্টার রাউন্ড দিচ্ছিল। আশেপাশের সব বাড়ির ছাদ থেকে মানুষ হেলিকপ্টার দেখতাছিল। আমার বাসা থেকে মেইনরোড (ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক) দেখা যায় না। আমি বারান্দায় গেলাম কাপড় আনতে। সুমাইয়া ওর বাচ্চাটারে ঘুম পাড়াইয়া বারান্দায় আসে। পাশে এসে বলে, মাগো কি হইতেছে, সবাই ছাদে দাঁড়ায় কি দেখে? এর কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা আওয়াজ পাইলাম। আওয়াজটা খুব একটা জোরে হয় নাই। আশেপাশে তাকাইলাম কি হইছে দেখতে। এর মধ্যে দেখি, আমার মাইয়া (সুমাইয়া) মাটিতে পইড়া গেল। ভাবছি, দুর্বল ছিল, মাথা ঘোরাইছে নাকি। ওরে ধরতেই দেখি মাথা থেকে ফিনকির মতো রক্ত ছুটতাছে। মুহূর্তেই ঘর রক্তে ভাইসা গেল। চিৎকার দিয়ে সবাইরে ডাকলাম, আমার মাইয়ারে বাঁচান, ওর গুলি লাগছে। হাসপাতালে নেয়ার আগেই মাইয়া আমার মারা যায়। মরণের আগে বলতেও পারে নাই, মাইয়াটারে দেইখো মা। এ কথাগুলো বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে নিহত সুমাইয়ার মা আসমা বেগম (৪৪)।

গত ২০ জুলাই বিকেলে সিদ্ধিরগঞ্জের নিজ বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে সুমাইয়ার (২০) মাথায়। মুহূর্তের মধ্যে একমাত্র মেয়ে সুয়াইবাকে (৭ মাস) রেখে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।

মায়ের মৃত্যুর পর শিশুটির বাবা জাহিদ ইসলাম (২৪) সুয়াইবার কোন খোঁজ নেননি বলে জানান তার পরিবার। মা-বাবা ছাড়া শিশুটির শেষ ভরসাস্থল এখন তার নানী।

নিহতের পরিবার জানায়, সুমাইয়ার পৈত্রিক নিবাস বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে। কয়েক বছর ধরে তারা সিদ্ধিরগঞ্জে বসবাস করছেন। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সুমাইয়া ছিলেন তৃতীয়। আড়াই বছর আগে তার বিয়ে হয়। স্বামী জাহিদ হোসেন কাজ করেন স্থানীয় একটি কারখানায়। জাহিদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। চলতি বছরের ১২ মে দুজনের সংসারে আগমন হয় মেয়ে সুয়াইবার।

সম্প্রতি সিদ্ধিরগঞ্জে সুমাইয়াদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ঘুমিয়ে আছে অসুস্থ সুয়াইবা। সে সাত মাস শেষে আট মাসে পড়েছে। একটু একটু করে কথার ধ্বনি ফুটছে। মুখে মা বোল, কিন্তু পৃথিবীতে তার মা আর নেই।

রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সুমাইয়ার পরিবারের সদস্যদের ।

লোমহর্ষক সেই দিনের কথা মনে করে আসমা বেগম বলেন, ঘুমন্ত অবস্থায় দুধের বাচ্চারে রাইখা মাইয়াটা মারা গেল। মরণের দুই দিন পর্যন্ত মার দুধের নেশায় বাচ্চাটা ছটফট করছে, কানছে। দুই দিন পর ফিডার ঠিকমতো খাইছে। সুমাইয়ার অনেক ইচ্ছা ছিল, মায়ের ডাক শুনবে। আমারে প্রায়ই বলত, সুয়াইবা কয় মাস হইলে মা ডাকবে?

আমি বলতাম সময় হলেই ডাকবনে। নাতিন আমার মা ডাকে, কয়দিন আম্মা আম্মা ডাকছে। মা ডাকার সময় আইলো, সুমাইয়া তো নাই। ওয় মা ডাকলেই চোখের পানি আটকাইয়া রাখতে পারি না। সুমাইয়া নিজের নামের সাথে মিলাইয়া সুয়াইবার নাম রাখছে। এটারেই এখন সুমাইয়া মনে হয়। চোখ মুখ দেখতে একদম মায়ের মতোন হইছে। সুয়াইবা হাসলে মনে হয় আমার মাইয়াডা হাসতাছে।

সুমাইয়ার মৃত্যুর পর তার পরিবারে একদিকে শোকের আবহ ছিল, অন্যদিকে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের হুমকিতেও দিন কাটিয়েছেন বলে জানায় সুমাইয়ার পরিবার। তাকে সিদ্ধিরগঞ্জ কবরস্থানে দাফনের পর ছাত্রলীগের কর্মীরা তার পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে হেনস্তা করে।

তবে ৫ আগস্টের পর বদলে যায় পরিস্থিতি। সুমাইয়ার বড়বোনের স্বামী বিল্লাল হোসেন বাদী হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করেন।

নিহতের ভাই (১৭) শাকিল বলেন, আমার বইনের জীবনে সুখ ছিল না। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের কারণে অনেক অত্যাচার সহ্য করছে বইনটা। অনেক চুপচাপ থাকত। ওর বাচ্চাটাই একমাত্র খুশির কারণ ছিল। ওয় জনম অভাগী। অভাগী না হলে বাচ্চাটা হওয়ার আড়াইমাসের মধ্যে ওর এমন মরণ হয়! ওর মাইয়াটারে দুনিয়ায় এতিম বানায় গেলো। সুয়াইবার বাবা জন্মের পর ওরে দেখতেও আসে নাই।

শিশু সুয়াইবার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত দরিদ্র আসমা বেগম। তিনি বলেন, সুমাইয়ার আব্বা (৫৫) করোনার সময় মারা গেছে। এরপর থেকেই আমাদের ঘরের অবস্থা তেমন একটা ভালো না। আমার ছেলে ছোট একটা চাকরি করে। কোন রকমে সংসার চলে। নাতিটারে কেমনে বড় করুম জানি না। এরমধ্যে কিছু সহযোগিতা পেয়েছিলাম। এই টাকা নেওয়ার জন্য জাহিদ আর তার বাবা আমাদের নানাভাবে চাপ দিচ্ছে। পিতা-মাতাহীন নাতিনের ভবিষ্যতের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।

এ পর্যন্ত কোন সহায়তা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে নিহতের বড়বোনের স্বামী বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ২ লাখ টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছে। এছাড়া কোন আর্থিক সাহায্য পাইনি আমরা।’