শিরোনাম
প্রতিবেদন : বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : আমার ছেলে তো রাজনীতি করতো না, সে তো ফুটপাতে পাপোশ বিক্রি করতো। আমরা তো গরিব মানুষ। আমার ছেলেকে কেন এভাবে গুলি করে মেরে ফেলা হলো? আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।
রাজধানীর কামরাঙ্গীচরের চাঁদ মসজিদ এলাকার ৩ নং রোডের ভাড়া বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমন কথা বলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহিদ মো. শাজাহানের মা আয়শা বেগম (৪৮)।
তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। আমার ছেলে তো রাজনীতি করতো না, সে তো ফুটপাতে পাপোশ বিক্রি করতো। আমার ছেলেকে কেন এভাবে গুলি করে মেরে ফেলল? আমি আমার ছেলেকে ফেরত চাই। দুপুরে দোকানে আসার কথা বলে বাসা থেকে বের হয় সে। ঢাকা মেডিকেলে এসে দেখি আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে।
মা আয়েশা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে নিউমার্কেট এলাকায় ফুটপাতের পাশে ব্যবসা করতো। সন্ধ্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র আমাকে ফোন করে। তিনি জানান আমার ছেলে গুলিতে আহত হয়েছে। সে পপুলার হাসপাতালে আছে। পরে আমি দ্রুত হাসপাতালে এসে জানতে পারি আমার ছেলেকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে সেখানে গিয়ে মরদেহ শনাক্ত করি।’
অনেক কষ্ট করে শাজাহানকে বড় করে তোলার কথা জানিয়ে আয়েশা খাতুন আরো বলেন, ‘এত কষ্ট করে শাজাহানকে বড় করে তুললাম, বিয়ে করালাম, আজ গুলি করে আমার ছেলেকে মেরে ফেলা হলো। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে রাজধানী সাইন্সল্যাবে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন নিউমার্কেট এলাকার বলাকা সিনেমা হলের পাশে ফুটপাতে পাপোশ ব্যবসায়ী মো. শাজাহান। তার বয়স হয়েছিল ২৫ বছর। শুরু থেকে ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে আন্দোলনে যোগ দিতেন তিনি। শাজাহানেরনাকের ডানপাশে গুলি লেগে মাথার পিছন দিয়ে বের হয়ে যায়। শাজাহানের স্ত্রী পাঁচ মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা, নাম ফাতিহা খাতুন (২০)। বাবা ঈমান আলী (৫৪)। শাজাহানের আরও ২ বড় ভাই ও ছোট ১টি বোন রয়েছে। দুই ভাই পড়ালেখা না করলেও বোন শাওরিন হাফছা ইডেন কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন। এখন শাজাহানের ব্যবসা সামলান তার বাবা ও মেজো ভাই মো. শাওন। বড় ভাই শাউমিন বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা থাকেন।
স্বামীর এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না শাজাহানের অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রী ফাতিহা খাতুন। তিনি বলেন, ‘চার বছর আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিলো আমাদের। এরপর আমরা ঢাকার কামরাঙ্গির চড়ে বাসাভাড়া নেই। শাজাহানের নিউমার্কেটর পাশে ফুটপাতে ‘পাপোশ’ বিক্রি করতো। তার উপার্জনই ছিল আমাদের ভরসা। ওই দিন সকালে না খেয়ে বেরিয়ে যান আমার স্বামী। এরপর টিভিতে গণ্ডগোল হওয়ার খবর শুনি। দুপুর ১২টায় ওকে (শাজাহান) ফোন করি। আবার বেলা ৩টায় তাঁকে ফোন করি। আমি বারবার জিজ্ঞাসা করি, ‘তুমি কোথায়? তখন সে বারবার বলছিল, আমি নিরাপদে আছি। বাসায় ফিরে আসছি।’
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বারবার বলছিলেন, ‘এই বয়সে আমি বিধবা হয়ে গেলাম। আমার অনাগত সন্তানের কি হবে? সে আর বাবাকে আর দেখতে পাবে না। আমি কিভাবে সন্তানকে মানুষ করবো? যাঁদের কারণে আমার স্বামীর প্রাণ গেছে, আমি তাঁদের বিচার চাই।’
পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৬ জুলাই আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ঢাকা কলেজের গেইটের সামনে একটি বুলেট এসে লাগে শাজাহানেরনাকের ডান পাশে। এতে গুরুতর আহত হন তিনি। ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু হাসপাতালে নেয়ার আগেই তিনি ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। এতে ছেলেহারা হন মা আয়শা বেগম। স্বামীহারা হয়ে পড়েন বিশবছর বয়সী ফাতিহা।
শহিদ শাজাহানের গ্রামের বাড়ি ছিলো ভোলার দৌলতখান উপজেলার মেঘনা নদীর মধ্যবর্তী দ্বীপ ইউনিয়ন হাজীপুরে। নদীর ভাঙ্গণে তাদের বসতভিটা বিলীন হয়ে গেলে পরিবারটি এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসে কামরাঙ্গীচর এলকায় বসবাস শুরু করে। গ্রামের বাড়িতে বসতবাড়ি না থাকায় তারা আর এলাকায় যাননা।
শাজাহানেরমা আয়শা বেগম জানান, অসুস্থ স্বামী মহসিন মিয়া ও তিন ছেলে শাওন, শাউমিন এবং শাজাহানকে নিয়ে প্রায় ২৫ বছর আগে ঢাকায় এসে কামরাঙ্গীর চরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকেন তারা। সেখানকার ৫৬ নং ওয়ার্ড চাঁদ মসজিদ সংলগ্ন ৩ নং গলির ‘ঠাকঠুক ওয়ালা’ নামক এলাকার বাসিন্দা সিরাজ মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকেন তারা। কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বামী মহসিন মিয়া মারা যান। ফলে অসহায় আয়শা বেগম তার ছোট্ট তিন ছেলেকেই কাজে দিয়ে দেন। নাবালক ছেলেদের রোজগারের টাকায় কোনভাবে চলছিল সংসার। কিন্তু জীবন সংগ্রামের আরেক অধ্যায় শুরু করেন আয়শা বেগম। ভবিষ্যত অবলম্বনের তাগিদে বিয়ে করেন-মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার বিক্রমপুর গ্রামের বাসিন্দা ঈমান আলী নামের একজনকে।
এ বিষয়ে ঈমান আলী জানান, আয়শা বেগমকে বিয়ের পর থেকে তার আগের স্বামীর তিন ছেলেকে লালন-পালনের দায়িত্বভার তিনিই বহন করেন। আয়শার ঘরে তার একমাত্র কন্যা সন্তান হাফসা রয়েছেন।
তিনি জানান, ঢাকার নিউমার্কেটের কাছে ঢাকা কলেজের সামনে ফুটপাতে ‘পাপোশ’ বিক্রি করতেন শাজাহান। কিন্তু ১৬ জুলাইয়ের উত্তাল সেই দিনটিই যে শাজাহানের জীবনের শেষদিন হবে তা কে-ই বা জানতো ?
নিহতদের শহিদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে ঈমান আলী বলেন, আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, আমি চাই আমার ছেলেকে শহিদের মর্যাদা দেওয়া হোক। একই সাথে এই হত্যার পিছনে যারা জড়িত তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
শাজাহানের মেজো ভাই মো. শাওন বলেন, ছোট ভাইটা আন্দোলন করতে গিয়ে শহিদ হওয়ার পর থেকে এই দোকান আমি চালাই। আব্বা মাঝে মাঝে আসেন। ভাইতো প্রায় তিন লাখ টাকা ঋণ রেখে গেছে, সেটা কি ভাবে পরিশোধ করবো তাই নিয়ে পরিবারের সবাই চিন্তিত। আমার ভাইয়ের জন্য দোয়া করবেন। ভাইকে যারা গুলি করেছে আমি তাদের বিচার চাই।
প্রসঙ্গত, গত ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় পাপোশ ব্যবসায়ী শাজাহান আলীকে হত্যার অভিযোগে তার মা আয়শা বেগম ১৭ জুলাই /২০২৪ ইং ঢাকার নিউমার্কেট থানায় মামলা করেন। যার নম্বর-৮/৭৬।