বাসস
  ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৭
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:২৯

বাবা যে আর আসবেন না কোনদিন, এ সত্য কে বুঝাবে অবুঝ শিশু শান্তকে

প্রতিবেদন : মো. এনামুল

পটুয়াখালী, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : তিন বছরের অবুঝ শিশু শান্ত। সে জানে না বাবা আর নেই। বাবা আর ফিরবে না কোনদিন। যার ফলে পরিবারের সদস্যদের কাছে সে জানতে চায়, আমার বাবা কোথায়? কখন আসবে বাবা? আমাকে মজা কিনে দেবে কে? বাবা এখনো আসে না কেন?

কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারো। কারণ শান্তর বাবা যে আর আসবে না কখনো তার কাছে। তিনি যে চিরদিনের জন্য আদরের শিশু সন্তান শান্তকে ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। কিন্তু কে বুঝাবে তিন বছরের ছোট্ট অবুঝ শিশু শান্তকে?

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ১৯ জুলাই শুক্রবার যাত্রাবাড়ি বড় মাদরাসার সামনে পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে শহিদ হন ভ্যানচালক জাহাঙ্গীর মৃধা (৪৫)। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলের দ্বীপাশা গ্রামে। মরহুম ময়ন উদ্দিন মৃধার পাঁচ নম্বর সন্তান তিনি। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ঢাকার রায়েরবাগের ভাড়া বাসায় থাকতেন শহিদ জাহাঙ্গীর। তার স্ত্রীর নাম লাইজু বেগম (৩৯) এবং বড় ছেলে সুজন (১৮) ও ছোট ছেলে শান্ত (সাড়ে তিন বছর)।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসসকে শহিদ জাহাঙ্গীর মৃধার স্ত্রী লাইজু বেগম বলেন, দিনটি ছিলো ১৯ জুলাই শুক্রবার। প্রতিদিনের মতো সকালে পরিবারের সাথে ভাত খেয়েছেন আমার স্বামী। পরে আমাকে বলেন, দেশের পরিস্থিতি ভালো না। সকল মানুষজন রাস্তায় নেমেছে। আমারও বাসায় ভালো লাগে না। আমিও রাস্তায় নামবো।

কান্নাজড়িত কন্ঠে লাইজু বেগম আরো বলেন, শুক্রবার সকালে তিনি বাসায় বলে যান, আজ ছাত্রদের সাথে রাস্তায় জুমার নামাজ পড়বো। কিন্তু বেলা ১১টায় ছাত্ররা ফোন করে জানান,তিনি যাত্রাবাড়ির একটি হাসপাতালে আছেন। গিয়ে দেখি হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছেন আমার সন্তানদের বাবা, মৃত।  এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শহিদ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী।

তিনি বলেন, হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার স্বামী মাথার পেছনে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তা দেখার পরে আমি চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। পরে স্থানীয়রা আমার মাথায় পানি দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়েছে। আমি তখন পাগলের মতো আচরণ করছিলাম। ছাত্ররা আমাকে অনেকে বুঝিয়েছে। তারা বলেছে আন্টি, আংকেল শহিদ হয়েছে। আপনি শহিদের স্ত্রী। আল্লাহ আংকেলকে এই পর্যন্ত হায়াত দিয়েছে। এসব বলে সান্ত¦না দিচ্ছিল ছাত্র-জনতা।

লাইজু বেগম আরো বলেন, তখন যাত্রাবাড়ির পরিস্থিতি খুবই খারাপ। চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজ। থমথমে পরিস্থিতি সর্বত্র। পরে মেডিক্যালের ডাক্তাররা বললো, দ্রুত লাশ নিয়ে চলে যান। তা'না হলে এই লাশ নিতে পারবেন না। প্রশাসন কিংবা আওয়ামী লীগ নেতারা লাশ দেখলে নিতে দিবে না। ওই সময় আমরা আরো হতাশ হয়েছি। লাশ নেয়ার মতো কোনো গাড়িও পাচ্ছিলাম না। কিভাবে কি করবো ভেবে যখন হয়রান ঠিক তখনএই বিপদের সময় ছাত্ররা একটা ভ্যান নিয়ে পাশে দাঁড়ালো। সেই ভ্যানে করে লাশ রায়েরবাগে নিয়ে এসেছি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ জাহাঙ্গীর মৃধা জীবিকার তাগিদে রাজধানীতে থাকলেও তার মন পড়েছিলো গ্রামের বাড়ি বাউফলে। তাইতো তার স্ত্রীকে তিনি বলে গেছেন, যদি কখনো আমার মৃত্যু হয় তাহলে যেভাবেই হোক গ্রামের বাড়িতে কবর দেবে। কেননা আমার মৃত্যুর পরেও কবর দেখে তোমরা শান্তি পাবে। এসব কথা বিবেচনা করে আমার স্বামীকে বাউফলের দ্বীপাশা গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শহিদ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী।

তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হুকুমের কারণেই আজ আমি স্বামী হারা। আমার দুইটা সন্তান বাবা হারা। হাসিনার কারণে এতিম হয়েছে আমার দুই শিশু সন্তান। হাসিনার হুকুমে হাজার হাজার মায়ের বুক খালি হয়েছে। আমি প্রথমত দায়ি করছি শেখ হাসিনাকে। তার কঠিন বিচার চাই আমি। আমি যেন হাসিনার ফাঁসি দেখি। দ্বিতীয়ত, যারা আমার স্বামীকে গুলি করেছে তাদেরও বিচার চাই। এটাই আমার অন্তবর্তী সরকারের কাছে চাওয়া।

তিন বছরের শিশু শান্তকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কন্ঠে লাইজু বেগম বলেন, আমার এতটুকুন সন্তান বলে মা, বাবা কোথায়? কখন আসবে বাবা? দিনের পর রাত আসে রাতের পর দিন আসে বাবা কেন আসে না? আমি কি জবাব দেব শিশু সন্তানদের। আমি ভেবে পাই না। শেখ হাসিনা আমার স্বামীকে খুন করেনি, খুন করেছে আমাদের পরিবারের চারটি মানুষকে।

জাহাঙ্গীরের বড় ছেলে সুজন বাসসকে বলেন, আমার বাবার খুনি শেখ হাসিনার ফাঁসি চাই। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি ছিলেন বাবা। তিনি না থাকায় আমি এখন একটি কারখানায় কাজ করছি। সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার। তাই আমি চাই সরকার যেন আমাকে আমার গ্রামে একটি সরকারি চাকুরির ব্যবস্থা করে দেয়। যাতে আমি আমার বাবার কবরের পাশে থেকে পরিবার নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারি।

শহিদ জাহাঙ্গীরের ছোট বোন রাজিয়া বেগম (৪২) বাসসকে বলেন, আমাদের দুই ভাই-বোনে অনেক মিল ছিল। শুক্রবার সকালে আমার ভাই আমার সাথে ফোনে অনেকক্ষণ কথা বলেছে। আমার খোঁজখবর নিয়েছে। সকাল ৯টায় আমার সাথে কথা বলেছে আর ঠিক ১১টা ১৮ মিনিটে এক লোক ফোন করেন। আমি ফোন রিসিভ করলে তিনি আমাকে বলেন ফোনের মালিক আপনার সম্পর্কে কি হয়? জবাবে আমি বললাম আমার ভাই। তখন সে বললো আপনার ভাই তো আর নেই।

শহিদ জাহাঙ্গীরের ছোট বোন কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, পুলিশের গুলিতে আমার ভাই নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। আমার ভাইকে খুনের পর তার সংসারটি অচল হয়ে গেছে। দুই শিশু সন্তানের কাছ থেকে তার বাপকে কেড়ে নিয়েছে শেখ হাসিনা। একজন স্ত্রীর কাছ থেকে তার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে। আর পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে শেখ হাসিনা। আমি শেখ হাসিনা সরকারের বিচার চাই। হত্যাকারী পুলিশের আর হাসিনার ফাঁসি চাই।

শহিদ জাহাঙ্গীরের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। দলটি দুই দফায় দুই লাখ টাকা দিয়েছে এই অসহায় পরিবারটিকে। এছাড়া জুলাই ফাউন্ডেশনে আবেদন করা হয়েছে বলে জানান শহিদের স্ত্রী লাইজু বেগম। তার ঘর নেই বলে সরকারের কাছে একটি ঘর চাওয়ার পাশাপাশি তার বড় ছেলেকে একটি সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেবার আবেদনও জানিয়েছেন তিনি।