শিরোনাম
প্রতিবেদন : সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন
ঢাকা, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : প্রায় দুই মাস মৃত্যুর সাথে লড়াই শেষে হার মানলেন বাবলু মৃধা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ নির্মাণ শ্রমিক মো. বাবলু মৃধা গত ১৯ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। আর সংসারের দায় মেটাতে কলেজ ছেড়ে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নেন পুত্র তালিব।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনরত সতেরো বছর বয়সী পুত্র মো. আবু তালিবকে খুঁজতে যান পিতা বাবলু মৃধা (৪৭)। ঘটনাটি ১৯ জুলাইয়ের, যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া এলাকার। খুঁজতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
বাবলুর শোকাহত ছেলে তালিব সম্প্রতি বাসসের সাথে আলাপকালে বলেন, ‘সেদিন হাজার হাজার লোকের সাথে আমিও আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম বলে আমার বাবা আমাকে খুঁজতে শনির আখড়ায় গিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া একটি গুলি তার বুকে লেগে পেটের ভেতর আটকে যায়।’
দনিয়া ইউনিভার্সিটি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র তালিব তার দিনমজুর বাবার সঙ্গে যাত্রাবাড়ির দনিয়ার গুয়ালবাড়ি মোড় এলাকায় বসবাস করতেন। তার মা সীমা বেগম ও আড়াই বছরের ভাই মোঃ মহিম হাসান পটুয়াখালি জেলার দশমিনা উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে থাকেন।
তালিব জানান, সেদিন রাত ৮.৪০ মিনিটের দিকে তার বাবাসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হলে কয়েকজন অজ্ঞাতপরিচয় লোক তাদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার বাবাকে প্রথমে ধোলাইপাড় এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে রেফার করেন।
শোকাহত তালিব জানান, সন্ধ্যায় তার বাবা গুলিবিদ্ধ হলেও তারা রাত ২টার দিকে খবর পান।
তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত স্বরে বলেন, ‘আমার বাবাকে যখন ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমাদের গ্রামের প্রতিবেশী একজন পুলিশ অফিসার তাকে চিনতে পেরে আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে ফোন করেন। পরে চেয়ারম্যান গ্রামে আমার চাচাকে খবর দেন। অবশেষে আমি রাত ২টার দিকে চাচার কাছে খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যাই।’
হাসপাতালে পৌঁছানোর পর তালেব জানতে পারেন তার বাবাকে ঢামেক হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়েছে। তালিব জানান, তার বাবা মারা গেছে ভেবে ঢামেক হাসপাতালের কিছু লোক তাকে ফেলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই পুলিশ অফিসার তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
বাবলু ঢামেক হাসপাতালে ১ মাস ২০ দিন চিকিৎসা নেন। কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় পরে তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয়। গত১৯ সেপ্টেম্বর সকালে তিনি সিএমএইচ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ময়নাতদন্তের পর বাবলু মৃধার লাশ পটুয়াখালী জেলার দশমিনা উপজেলায় তাদের পৈতৃক বাড়িতে নিয়ে গিয়ে গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তালিব জানান, ছাত্র-জনতার বিদ্রোহের মুখে ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত তার পরিবারই চিকিৎসার খরচ বহন করে। তবে ৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ের সকল চিকিৎসার খরচ বহন করেছে সরকার।
তিনি আরো বলেন, ৩ আগস্ট পর্যন্ত আমার বাবার চিকিৎসার জন্য আমরা প্রায় এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ করেছি। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তবর্তীকালীন সরকার ৪ আগস্ট থেকে বাকি খরচ বহন করেছে।
আন্দোলনে যোগ দেওয়ার বিষয়ে তালিব জানান, তার বাবা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর সমর্থক ছিলেন। তিনি বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নিতেন।
বাবলুর শোকাহত ছেলে বলেন, ‘একজন ছাত্র হিসেবে আমি আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলাম। কিন্তু ১৭ জুলাই থেকে এই আন্দোলন যখন সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপ নেয় তখন আমার বাবাও আন্দোলনে যোগ দেন।’
তালিব জানান, তার বাবাও সেদিন শনিরআখড়া এলাকায় বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, একটি বুলেট তাকে তার বাবার কাছ থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজলা, শনির আখড়া ও রায়েরবাগসহ যাত্রাবাড়ি এলাকায় ১৭ জুলাই থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সব বয়সের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাজপথের বিক্ষোভে যোগ দেওয়ায় এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ২০ জুলাই কারফিউ জারি করে সরকার দৃশ্যত শহরের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হলেও, ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত যাত্রাবাড়ি এলাকা বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল।
তালিব বলেন, বাবার মৃত্যুর পর পুরো পরিবার একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কারণ বাবাই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন।
তালিব দুঃখ ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলেন, ‘আমার বাবা ২০ বছর ধরে গুয়ালবাড়ি মোড় এলাকায় নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে কাজ করছিলেন। আমি সেখানেই বাবার সাথে থাকতাম। তিনি আমার লেখাপড়ার খরচ বহন করতেন এবং গ্রামে আমার মা এবং ছোট ভাইয়ের জন্য টাকা পাঠাতেন।’
কিন্তু তালিব এখন নিজের পড়াশোনা নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। কারণ মা ও ছোট ভাইয়ের ভরণ পোষণের জন্য তিনি ইতোমধ্যেই নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে কাজে যোগদান করতে বাধ্য হয়েছেন।
তালিব অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলেন, ‘জানি না আমি আমার পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারব কি না। কারণ নির্মাণ শ্রমিকের কাজের পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন।’
তালেব তার গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৩.৪৪ পেয়ে এসএসসি পাস করে দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হন। এর আগে তিনি তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত দনিয়া এলাকার স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গ্রামে গিয়ে সেখান থেকে এসএসসি পাস করেন।
বর্তমানে ধোলাইপাড় এলাকায় একটি ব্যাচেলর মেসের বাসিন্দা তালিব বলেন, ‘আমাদের কোন জমি বা বাড়ি নেই। আমরা দিন এনে দিন খাওয়া পরিবার। এখন প্রতিমাসে আমি প্রায় দশ হাজার থেকে বারো হাজার টাকা আয় করতে পারি। এই টাকা থেকেই আমি আমার খরচ বহন করে মায়ের কাছে টাকা পাঠাই।’
তিনি বলেন, বাবার মৃত্যুর পর থেকে স্থানীয় এক বিএনপি নেতা ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সহায়তা করেছেন। এছাড়া সরকারি বা বেসরকারি নগদ কোনো সহায়তা পাইনি।
বাবলুর শোকাহত পুত্র তালেব বলেন, ‘আমরা আর কখনোই আমার বাবাকে ফিরে পাবো না। তিনি আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন এবং আমাকে পড়াশোনা করতে উৎসাহিত করতেন। কিন্তু বর্তমানে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালিয়ে পড়ালেখা করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় যদি সরকার আমাদের পরিবার চালাতে সহায়তা করে অথবা আমাকে একটা উপযুক্ত চাকুরি দেয় তাহলে পরিবারের ভরণ- পোষণের পাশাপাশি আমি পড়ালেখাও চালিয়ে যেতে পারতাম।’
তালিবের মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে তালিব জানান, তার মা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না।