বাসস
  ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২১
আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১:০৯

মাকে আর হজ্জে পাঠাতে পারলেন না শহিদ সায়মন

প্রতিবেদন: মোহাম্মদ আবু বক্কর

চট্টগ্রাম, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার হারামিয়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের সিকদার বাড়ির মৃত আমিন রসুলের ছেলে মো. মাহিন হোসেন সায়মন।  ট্রাক ড্রাইভার আমিন রসুল ১২ বছর আগে ক্যান্সারে মারা যান। তখন সায়মন এর বয়স ছিল মাত্র চার বছর। আর বড় ভাই তুহিনের আট। 

বাবার মৃত্যুর পর তাঁর মা রহিমা বেগম দুই সন্তানকে নিয়ে স্বামীর সংসারে থেকে যান। দুই অনাথ সন্তানের কথা চিন্তা করে আর বিয়ে করেননি। মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে এবং কাঁথা সেলাই করে অতি দুঃখ-কষ্টে সংসার চালাতেন বিধবা রহিমা বেগম। 

সায়মনের বড় ভাই মো. তুহিন (২৫) ছোটবেলা থেকেই বুদ্ধিহীন-সাধাসিদে প্রকৃতির হওয়ায় কোন কাজ কর্ম করতো না। তাই বিধবা মায়ের দুঃখ ঘোচাতে ছয় বছর বয়সে গ্রামের চায়ের দোকানে দৈনিক ৩০টাকা বেতনে চাকরি নেয় শিশু সায়মন। সংসারের হাল ধরতে ১০বছর বয়সে গ্রাম ছেড়ে চলে আসে চট্টগ্রাম শহরে। প্রথমে কিছুদিন মুরাদপুরে একটি গাড়ির ওয়ার্কশপে কাজ করে। পরবর্তী সময়ে বহদ্দারহাট হক মার্কেটে মুদির দোকানে চাকরি শুরু করে। সহকর্মী হাসানের সাথে সে খতিবেরহাট এলাকায় মেসে ভাড়া থাকতো।

কাজের ব্যস্ততায় দীর্ঘ চারমাস বাড়ি যেতে পারেনি সায়মন। তাই ছেলেকে দেখতে ব্যাকুল হয়ে উঠেন তাঁর মা রহিমা বেগম (৪৮)। ছেলের জন্য নিজ হাতে পিঠা বানিয়ে ছুটে আসেন চট্টগ্রাম শহরের বন্দর ফকিরহাট এলাকায় ছোটবোন নাঈমার বাসায়। ইতোমধ্যে খালার বাসায় গিয়ে সে একবার মায়ের সাথে দেখা করে আসে। বৃহস্পতিবার মায়ের সাথে দেখা করতে খালার বাসায় যাওয়ার কথা দোকান মালিক মিঠু চৌধুরীকে সায়মন আগেই বলে রেখেছিল।

গত ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) দুপুর ২টা, নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের সাথে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয় যা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আতঙ্কিত হয়ে আশেপাশের মার্কেটের ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে দেয়। বহদ্দারহাট হক মার্কেটের ‘জয় এন্টারপ্রাইজ’ এর স্বত্ত্বাধিকারী মিঠু চৌধুরীও দোকান বন্ধ করে সায়মনসহ বাকি কর্মচারীদের ছুটি দিয়ে দেন। 

পরদিন ১৯ জুলাই (শুক্রবার) বিকেলে দোকান খোলার পর তিনি কর্মচারী হাসানের কাছ থেকে সায়মনের ব্যাপারে জানতে চান। জবাবে হাসান জানায়, সায়মন গতরাতে মেসে যায়নি। দোকান মালিক মিঠু চৌধুরী মনে করেন সে হয়তো মায়ের সাথে দেখা করতে খালার বাসায় গেছে। সন্ধ্যায় খালা নাঈমা ফোন করে সায়মনের খোঁজ করেন। তখন দোকান মালিক নিশ্চিত হন গতকাল সে খালার বাসায়ও যায়নি। এ সময় অজানা এক আতঙ্ক তাঁর মনে ভর করে। তিনি রাতে সম্ভাব্য সব জায়গায় সায়মনকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন। এরপর ২০ জুলাই (শনিবার) তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে সায়মনের খোঁজ করেন। কিন্তু কোথাও না পেয়ে শেষমেষ হাসপাতালের মর্গে যান। সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ মর্গে থাকা লাশগুলো দেখালে মিঠু চৌধুরী তাঁর কর্মচারি সায়মনের লাশ শনাক্ত করেন। বিষয়টি তিনি সাথে সাথে সায়মনের খালু সুমনকে ফোন করে জানান। সুমন তাঁর স্ত্রী নাইমা এবং সায়মনের মা রহিমা বেগম কে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন। অতি আদরের সন্তানের নিথর মরদেহ দেখে মুর্ছা যান মা রহিমা বেগম। তাঁর আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে উঠে হাসপাতালের পরিবেশ। ২১ জুলাই রবিবার ট্রলারে করে সন্তানের লাশ নিয়ে বাড়িতে ফিরেন হতভাগিনী মা। সেদিন বিকেলে পারিবারিক কবরস্থানে সায়মনকে দাফন করা হয়।

জানা যায়, গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের সাথে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সাথে সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় কিশোর সায়মন। গণ্ডগোলের কারণে কর্মস্থল বহদ্দারহাট হক মার্কেটের মুদি দোকান ‘জয় এন্টারপ্রাইজ’ বন্ধ করে দিলে খালার বাসায় মাকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল তার। দোকান থেকে বেরিয়ে সে ছাত্রদের সাথে আন্দোলনে যোগ দেয় এবং পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়। তাঁর বুকে ও পিঠে গুলি লাগে। তিনদিন অজ্ঞাত লাশ হিসেবে হাসপাতালের মর্গে পড়ে ছিল তাঁর মৃতদেহ। ঘাতকের বুলেটে ১৬ বছরেই থেমে গেল সম্ভাবনাময় কিশোর সায়মনের জীবন।

শহিদ সায়মনের পরিবারের সাথে দেখা করতে বাসস প্রতিনিধি সন্দ্বীপ উপজেলার হারামিয়া ইউনিয়নে মৃত আমিন রসুলের বাড়িতে যান। কথা হয় শহিদ সায়মনের শোকাহত মায়ের সাথে। স্বামীর রেখে যাওয়া জরাজীর্ণ বাড়িটি কিছুদিন আগে একটি এনজিও সংস্থা টিন দিয়ে মেরামত করে দেয়। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সায়মনকে হারিয়ে তাঁর মা রহিমা বেগম এখন দিশেহারা। 

সন্তান হারানোর বেদনায় কাতর মা রহিমা বেগম বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর চরম আর্থিক অভাব অনটনের মধ্যে সংসারের দিন কেটেছে। টাকার অভাবে ছেলেগুলোকে পড়ালেখা করাতে পারিনি। বড় ছেলেটা একটু সহজ-সরল প্রকৃতির। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ে ছোট ছেলে সায়মন পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধের ওপর তুলে নেয়। ছেলের জীবনটাই গেলো দুঃখ-কষ্টে। পরিবারের জন্য ছোটবেলা থেকে মেলা কষ্ট করছে। খেলাধূলার বয়সে চায়ের দোকানে চাকরি করছে। সংসারের অভাব দূর করতে মানিক আমার শহরে গেছে। মুদির দোকানে কাজ করে যা রোজগার করতো আমার কাছে পাঠিয়ে দিত। নিজের জন্য একটা পয়সাও রাখতো না। সবসময় শুধু পরিবার নিয়ে চিন্তা। মাকে নিয়ে চিন্তা। আমার মানিককে ছাড়া আমি এখন কিভাবে থাকবো? কে আমাকে জড়ায় ধরে আম্মা, আম্মা ডাকবে?

তিনি আরো বলেন, ছেলে বাড়িতে বেড়াতে আসলেও কাজ করতো। আমি নিষেধ করলে বলতো, ‘মা,আপনি অনেক কষ্ট করছেন। আমাদের অভাবের সংসার। কষ্ট করে চলতে হবে। আপনি দোয়া করলে আমাদের সব হবে। আমাকে শুধু দুইটা বছর সময় দেন। আমি ব্যবসা শিখে ফেলছি। মামা থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করবো। খুব তাড়াতাড়ি প্রতিষ্ঠিত হবো। আপনাকে হজ্ব করাবো। আমাদের ঘরটা করে ফেলবো। আল্লাহ আশা পূরণ করবেন। আমাদের অভাব আর থাকবে না।’

সরকারের কাছে কিছু চাওয়ার আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সব আশা ভরসা ছিল সায়মনকে নিয়ে। তার উপার্জন দিয়ে আমরা চলতাম। ছেলে কে তো কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। আমার নিষ্পাপ পোলাটারে যারা গুলি করে মারছে আমি তাদের বিচার চাই। এখন আমরা চলবো কিভাবে? আর্থিক টানাপোড়নের কারণে একটা টিউবয়েল পর্যন্ত বসাতে পারিনি। অন্যের বাড়ি থেকে পানি এনে খেতে হয়। সায়মনের স্বপ্ন ছিল ঘরটা পাকা করবে। সরকার যদি আমার ঘরটা পাকা করে দেয় তাহলে অন্তত আমাদের মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হবে। বড় ছেলেটা বেকার। তাকে যদি একটা সরকারি চাকরি দেওয়া হয় তাহলে আমার সংসারটা চলবে। 

সায়মনের বৃদ্ধ নানা মো. রিদোয়ান (৮০) বলেন, আমার ছোট নাতিটা শহরে চাকরি করে পরিবার চালাতো। যা রোজগার করতো সব মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিত। বয়স কম হলেও আল্লাহ তাঁকে অনেক বুঝ-ব্যবস্থা দিয়েছিল। গত ঈদে আমার জন্য পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি নিয়ে এসেছিল। খরচের কথা চিন্তা করে সে কোরবানি ঈদে বাড়িতে আসেনি। অল্পবয়সে আল্লাহ নাতিটারে উঠায় নিয়ে গেছে। সরকার যেন আমার মেয়ের পরিবারটার দিকে একটু তাকায়।

শহিদ কিশোর সায়মনের খালু মোহাম্মদ সুমন বলেন, ছোটবেলা থেকেই সায়মন খুব কর্মঠ ছিল। পরিবারে সচ্ছলতা আনতে চার বছর আগে চট্টগ্রাম শহরে আসে। প্রতি বৃহস্পতিবার আমার বাসায় খালাকে দেখতে আসতো। মায়ের কাছে পাঠানোর জন্য টাকা দিয়ে যেত। ঘটনার দিনও তার আসার কথা ছিল, কিন্তু সে আসেনি। পরদিন ১৯ জুলাই গণ্ডগোলের মধ্যে আমি আমার স্ত্রী মিলে বিভিন্ন জায়গায় তাঁর খোঁজ করি। ২০ জুলাই তাঁর দোকান মালিকের কাছ থেকে মৃত্যুর খবরটি জানতে পারি। সংসারের হাল ধরতে এসে লাশ হয়ে তাঁকে বাড়ি ফিরতে হয়েছে।

এ বিষয়ে সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিগ্যান চাকমার সাথে বাসস প্রতিনিধির কথা হয় । 

তিনি বলেন, আমরা শুরু থেকে সায়মনের পরিবারের পাশে আছি। উপজেলা প্রশাসন থেকে ইতোমধ্যে সায়মনের পরিবারকে একলক্ষ টাকা সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। সরকারিভাবে কোন সহযোগিতা পেলে অবশ্যই তাঁর পরিবারের নিকট পৌঁছে দেয়া হবে। 
এসময় সায়মনের মায়ের অনুরোধে একটি টিউবয়েল স্থাপনের বিষয় ইউএনও কে অবহিত করা হলে তিনি অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আশ্বস্ত করেন।